জ্বলদর্চি

পায়েল বোস ও এক নম্বর আপ তারকেশ্বর লোকাল/ শুভদীপ মাইতি

পায়েল বোস ও এক নম্বর আপ তারকেশ্বর লোকাল                                                                    
শুভদীপ মাইতি 

১.
সন্ধ্যা সাতটা আটত্রিশ মিনিট‌।
একটা লোকাল এসে দাঁড়াল প্ল্যাটফর্মের কান্না জড়ানো অন্ধকারের ভেতর

জনপদে নেমে যাচ্ছে ব্যস্ততা। উঠেও আসছে

চোখে পড়ল শুধু একটা ঝুড়িভরা সাদা ফুল।
লড়াইয়ের গন্ধে, বর্ণে; চামড়ার ব্যাগগুলো ঘামছিল।
শ্যাওড়াফুলি পরবর্তী অস্থিরতায় দিয়াড়া, নসিবপুর, তারকেশ্বর লাইন;
নিভে আসছে উল্লাসনগর, উৎসবমুখর উচ্চারণের আলো।
পূর্ব নির্ধারিত হত্যার উচ্ছ্বাসে, কামার কুন্ডু, নালিকুল।
অনন্ত অপেক্ষায় চেয়ে থাকে হরিপালের প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন, দই

একটা পিঁপড়ে অনন্ত কাল ধরে মৃত জ্যোৎস্নার টুকরো বয়ে আনছে,
পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে।
একজন গ্রন্থাগারিক ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে রাখছেন পুস্তক।
আর আমি রাতভর ঘুমানোর ভান করে জেগে থাকা জ্যামিতিক কান্নার ছায়া

এ শহরে তোমার কোনো শব্দ নেই। সিঙ্গুর সাত মন্দির তলার তঞ্চকতায়,
শরীরের পেছনে যথারীতি ছুরি। হত্যা বিষয়ক দিন, 'তিথি',
নুপূরের শব্দে শব্দে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে স্রোত

ভাড়াটে ঘর।
শীতল চায়ের রেসিপিতে বেঁধে রাখে মাঞ্চুরিয়ান, ভেজ মান্চাউ স্যুপ।

সিঙ্গুর স্টেশন থেকে একটি পরাবাস্তব রাস্তা এগিয়ে যাচ্ছে,
লাল রক্তের দেওয়ালের দিকে।
প্রতিটি পদে পদে প্রকট হচ্ছেন পাথরপ্রতিমা রেলগেট,
ডায়রির পাতায় পাতায় লিখে রাখা অপ্রিয় চাবুকের ক্ষত।

🍂
ad

২.
হাওড়া স্টেশনের এক, দুই কিংবা তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে,
ধীরে ধীরে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে আপ তারকেশ্বর লোকাল।
শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে এই ট্রেন যেন এক আন্দোলনের প্রতীক।
গ্রামের বিপরীতে ফেরা, অথবা সহস্র যোজন শেকড়ের দিকে;
জিরো পয়েন্টে তাক করে রাখা আছে চাষ‌ অযোগ্য অনুর্বর জমি।

চোখে চোখে ছায়া পড়ছে। পায়েল বোসের কোমলতায় গিলে নিচ্ছে সমগ্র।
সকালবেলার কুয়াশায়, গাল ছুঁয়ে হালকা হচ্ছে হাওয়া।
চলমান ট্রেনের জানালায় সরে সরে যাচ্ছে মুখ, এস্রাজের সুর,
সরে যাচ্ছে ধানক্ষেত, পুকুর পাড়, তালগাছের সারি।

তার দৃষ্টিতে জ্বলে ওঠে চকমকি পাথর। ভেতরের খাঁ খাঁ হাইওয়ে।
অথচ একটি যাত্রাপথ শহর ছেড়ে পৌঁছে যায় গ্রামীণ হৃদয়ের গভীরে 

একজন কিশোর রামধনু রঙের সুখ স্মৃতি ও জন্মের আগের অদৃশ্য রূপান্তরিত দহনে,
স্রোতস্বিনী মেনস্টুয়াল দুপুরবেলায়, প্রিয়তম উপশম দিচ্ছে,
ট্রেনাস্কেমিক ও ফেফিনিমিক অ্যাসিড।

ঘড়ির কাঁটায় যখন ভুলে যাচ্ছে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের নিজস্ব সংলাপ,
নিজেকে চাবকাতে চাবকাতে ফিরে আসছে তরতাজা বাইশ‌ বছর;
অসংরক্ষিত মানতের উঠোন।


৩.
মেটাফিজিক্স পড়া ছেঁড়া পাতার কোণে, গোপনে খুলে যাচ্ছে দরজা।
ছায়াবৎ দাঁড়িয়ে বাল্যপ্রেমিক। গন্তব্যবিহীন সময় প্রস্তাবনায় আটকে আছে,
মেরিলিন মনরো এবং একটা ভুল করে ফেলে আসা জীবন।

সময় কেটে এগোচ্ছে লোকাল ট্রেন ও ঘড়ির কাঁটা।
গভীর রাতে নেমে এলে নিদ্রা,
লিলাময় দাসের বাড়ির উঠোনে হাজার হাজার বিন্দু বিন্দু জোনাকির আলো।

মিথ্যে মায়াজালে জড়িয়ে পড়ছে এফোঁড় ওফোঁড়। সহজ সরল অন্তর্গত টান।
এমন কাব্যময় দিনে বসন্ত আরোও বেশি মশগুল পলাশের রঙে

তার লুকিয়ে রাখা তঞ্চকতা ছুরির চেয়েও তীব্র।
তবুও কোন অভিযোগ নেই নিজেকে নিংড়ে দেওয়া অপর প্রান্তে।
অতীতে ফিরে যাওয়ার নিষিদ্ধ চরে, এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে।
অনিচ্ছুক কৃষকের লড়াইয়ের মাঠে প্রতারণায় পড়ে আছে ছুঁচ, সুতো

মাঝখানে সহস্র যোজন ব্যবধান। আমরা হেঁটে যাচ্ছি নিজস্ব গন্তব্যে।
অথচ ফেলে আসা আত্মার পাশে, নিঃশব্দে ঝরে পড়ছে বৃষ্টি


৪.
একজন হিমায়িত পুরুষ কড়িকাঠে হেলান দিয়ে,
মগ্ন হয়ে আছেন তপস্যায়।
লাল কাপড়ে মোড়া পুরনো বিষাদের বাক্সে, এ শহর হেঁটে যায়।
ভেতরে পাড় ভাঙে, আগের জীবন ও পরবর্তী স্টেশনের ঘোষণায়

ছলাৎছল স্বপ্ন ভাঙছে। অনশনে ভাঙছে জল।
সম্পর্কে আলগা হচ্ছে মাটি

কৃষকজন্মের স্থাবর, অস্থাবর উর্বর জমির ওপর দিয়ে 
বয়ে যাচ্ছে অজগর বিষন্ন মোচড়।
পাশ‌ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ফুটপাত ও হাইওয়ে।
ট্রেনের পেছনের কামরায়, কাছাকাছি এসেও,
মুখোশে আড়াল থাকে পরস্পর বিপরীতমুখী স্রোত।

আবহাওয়া পাল্টে গেলে রেললাইনের ইস্পাতে মুখোমুখি শুয়ে আছে ফেব্রুয়ারি মাস।
তারা আঁচড় কাটছে সমান্তরাল। ছেড়ে যাচ্ছে মনোলতা, লাস্ট ট্রেন, আপ ও ডাউনে


৫.
চোখের কাজল বাসি হলে, কুয়াশার আদ্রতায় গলে যায়,
লাবন্যপ্রভা দোয়াঁশের মাটি।
চাগিয়ে ওঠে পুরনো মুখের ভ্রম।
চাল ফোটে। ফোটে খিদেও,
একান্ত মানতের থানে খই ফোটে অথবা অসুখ।

আমাদের অন্তঃসত্ত্বায় টান কমছে।
অলীক ধারায় বেড়ে উঠছে চারাগাছ, শূন্যতার রূপ।
তবুও বহন করে সময়সূচি;
জলমগ্ন আলোর নিচে অসমাপ্ত মফস্বল, সিঙ্গুর স্টেশন।

তার স্কার্ফের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে তৃতীয় পুরুষের মুখ।
মোম পুড়ছে। হৃদয়ের কোমল স্থানে, কবরডাঙা জুড়ে,
নকশা আঁকে কাঁকড়ামাটি, আত্মদহন রং 

রং চড়ছে। গনগনে তাপ।
বিশ্বাস ভেঙে ভেঙে, বারংবার কুমিরডাঙায় ওঁৎ পাতছে ঘাতক

জলপাই রঙের প্রেমে, হাঁটার চিহ্ন পড়ে থাকলে,
মাটির ভিজে থাকায় শরীরে শরীরে খুলে যাচ্ছে গিঁট।
শেওড়াফুলি এক পয়সা ফেরিঘাট থেকে হেঁটে যাচ্ছে,
শ্রাবণ মাসের জলভর্তি প্রিয় মুখ, উপশম ও কাঁধে ঝোলানো বাঁক।


৬.
গ্রামের পর গ্রাম। উজাড় হচ্ছে।
প্রাচীন ব্রত কথার বহুমাত্রিকতায়,
রাস্তা ভেঙে, ছোঁয়াচ ভেঙে, কোলাজে কোলাজে—
ফুটিয়ে তুলছে অন্তঃস্থ স্বর।

ভরবাহক কাঁধের দুইদিকে দুটি ঘট। মাটিজাত।
গঙ্গাজলে উপড়ে পড়ছে পাপ, তাপ, অনর্গল, 
প্রশ্বাসজাত আত্মদহন কাল।

আমরা প্রত্যেকেই পারস্পরিক ভালোবাসছি।
তিনটে তালগাছের টোটো স্ট্যান্ড ও ঠোঁটের স্পর্শে,
হ্যাপি চানাচুরের প্রত্যহ নাস্তার প্যাকেট এবং জলের দ্রবনে ভর দিয়ে;
ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ছে খাগড়াবনি বটতলা, খাঁ খাঁ শূন্য মাঠ।

চক্ষুদান পর্ব ও ইতস্তত প্রবঞ্চক তামসি বেলায়
আমরা পথ হাঁটছি।
ব্রতকথায় ভেসে আসছে কাঁটাতার,
আলো নিভছে। জ্বলেও উঠছে।

আঁধারের এপিঠ, ওপিঠ; জল নয়,
ভেঙে যাচ্ছে নরোত্তম মন্ত্রমুগ্ধ লৌহ কঠিন পুরুষ।


৭.
দড়ি ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে ফানুস।
নিরুদ্দেশের দিকে ফাঁকি দিচ্ছে স্বচ্ছতোয়া আবছা ভেজা চোখ

সে ইচ্ছেমতো সিগন্যাল ভাঙছে। ট্রাফিক রুলে ক্রমাগত জ্বলে উঠছে লাল‌ বর্ণের আলো।
আমাদের অন্তঃস্থ ও বহির্জগতের মধ্যিখানে জানালার খাঁজে খাঁজে
ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায় অসমাপ্ত নৃত্যরত ঘুঙুরের তাল।

নিজের ছায়ার দিকে কেউ নেই। অপেক্ষায় ডুবে যাওয়া শাঁখের নৈঃশব্দ্যে,
ধীরস্থির অথচ গাঢ় হচ্ছে কাজু বাগানের ঘ্রাণ।

স্টেশন ছাড়ার পূর্ব মুহুর্তে হৃদয় ক্ষত বিক্ষত করছে হুইসেল।
আমরা দগ্ধ হচ্ছি বসন্ত বিলাপ, পলাশের রঙে।

আমরা প্রত্যেকেই যখন আকাশ ছোঁয়ার কথা ভাবছি একে একে,
এই ট্রেন যাত্রার শেষ অংশে কেউ কেউ অনুভব করছেন সাউন্ডস্কেপ অথবা পুর্নাঙ্গ চিত্রধারণের মান

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJuly 14, 2025

    mon chhuye gelo subhadip da. vison valo likhechen.

    ReplyDelete