এই যে আলোর আকুলতা
আবীর ভট্টাচার্য
(সপ্তম অধ্যায়)
মফস্বলের ভোরগুলির একটা আলাদা গন্ধ থাকে, ভিজে-ভিজে, মনকেমনিয়া। আলোর প্রতীক্ষারত প্রকৃতির ধুসর অবয়বটি যেন মনে পড়িয়ে দেয়, প্রতিটি অন্ধকারই যেমন আলো-পথগামী, প্রতিটি স্মৃতিই তেমনই অতীত-সুখকামী। প্রভাতী রেওয়াজ, অনভ্যস্ত আলতাপায়ে শিশিরমাখা দূর্বা মাড়িয়ে শিউলী তোলা, ঝুঁজকো ছায়ায় চালতাতলায় কারো সাথে লাজনম্র প্রথমালাপ, ক্ষণিক স্পর্শসুখ মনে পড়ে যায়, অলক্ষ্য শীতকাতরতায় কুঁকড়ে যায় দেহমন, তবু শীতার্ত বন্ধ্যাত্ব পেরিয়ে নববসন্তের পত্র উন্মীলনের মতোই প্রতিটি ভোর ভৈঁরোয় ধরে তান, 'জাগো মোহন প্যায়েরে'…,জেগে ওঠে চরাচর, শুরু হয় দিন।
নতুন জায়গা, ভালো ঘুম হয়নি সারারাত, বারবার ছিঁড়ে যাচ্ছিল তন্দ্রাঘোর, তাই হয়তো পাখীর কলকাকলী শুনেই, ঘুমন্ত বিমলের দাম্পত্য-বাহুডোর সাবধানে সরিয়ে বিছানা ছাড়লেন অরূন্ধতী, বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলেন, অরূপ একা বসে আছেন, বারান্দার বেতের চেয়ারে, ওনার মোবাইলে গাইছেন ভীমসেন যোশী, রাগ ভৈরব। নিঃশব্দে পাশের চেয়ারটিতে এসে বসলেন, মৃদুকন্ঠে সুপ্রভাত বিনিময় হোল, যোশীজি বা পাখ-পাখালিদের বিরক্ত না করেই। ঐসময়েই ঘুম ভেঙে বাইরে বেরিয়ে এসে অরণি দেখলেন, দুই নারী-পুরুষ বসে আছেন পাশাপাশি, দুজনেই তাঁর বন্ধু, প্রিয়জন; তবু কোন এক অজানা কারণে অরূপের ওপরে ভীষন রাগ হয়ে গেল তাঁর, 'এই সাতসকালেই পরের বৌকে গান শোনানোর আছে টা কি শুনি!'...মনে মনে গজগজ করতে করতে প্রাতকৃত্যে মন দিলেন। সারাদিন ঘোরাঘুরি আছে, সকালটি যেন অন্যমনা না হয়…
খানিক পরেই সদলবলে শুরু হোল ভ্রমণযাত্রা, আজ গন্তব্য নয়াগ্রাম। উড়িষ্যা-বাংলা সীমান্তে, স্বাপদসংকুল ঘন অরণ্যবেষ্টিত জনপদ, মাঝে বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা। বইপত্রে অনেকেই পড়েছেন, রাজা মানসিংহের সৈন্যদলের এক সৈনিক হাউসিংহ প্রতিষ্ঠা করেন এই রাজ্য, কেউ বা বলেন, ত্রয়োদশ শতকের আফগান সুলতানেরা যখন মুহুর্মুহু উড়িষ্যা আক্রমনে ব্যস্ত, উড়িষ্যারাজ এই অঞ্চলের ভৌগোলিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে, এলাকার সামন্তদের সাহায্যে এই সব আক্রমণ প্রতিহত করেন, প্রতিদানে অসংখ্য গড় ও দুর্গ-মন্দির নির্মাণে সাহায্য করে, নিজেদের ও এলাকাবাসীর অস্তিত্ব সুরক্ষিত করেন, যার অধিকাংশ ভগ্নপ্রায় হলেও আপনার ধ্বংসপ্রাপ্ত পার্থিব শরীরে অতীতের লোমহর্ষক গল্পগাথা আর সেযুগের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শোনায়, কুহকমায়ায় ডাকে…...আয়,আয়।
শহুরে মানুষ জনের কানেও কখনও কখনও পৌঁছয় সেই সব অতীন্দ্রিয় আহ্বান; তাঁরা আসেন,ক্ষণিক দাঁড়ান। এই যেমন,লোধাশুলি,গোপীবল্লভপুরের সুবর্নরেখা সেতু পেরিয়ে গহন-বন উজিয়ে আমাদের ভ্রামকদলটি এসে পৌঁছেছেন খেলাড়গড়ের ধ্বংসস্তূপে। কথিত এই যে, ১৪৯০সালের আশেপাশে নির্মিত গভীর পরিখাবৃত মাকড়াপাথরের এই গড়টি ছিলো কারুকার্যময় স্তম্ভযুক্ত। আজ কিছুই নেই, ভগ্নপ্রায় প্রবেশদ্বার ও খিড়কিদ্বার ছাড়া, তবু গাছ-গাছালি,ঝোপঝাড়ের মধ্যে একা পড়ে থাকা অদ্ভুত সুন্দর নীলপাথরের অশ্বারোহী যুগলমুর্তি, ইতস্ততঃ ছড়িয়ে থাকা পাথরখন্ডগুলি, যেন কার কবেকার তৃপ্তি বা তৃষার গল্প শুনিয়ে যায়। যুক্তিবাদী আধুনিক মানুষ হয়েও যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, হয়তো অন্য কোন যুগে,অন্য কোনো নামে বা সম্পর্কে আমরাও ছিলাম তাদের স্বজন!
এই সব জনবিরল কুমারী প্রকৃতির বিরল সান্নিধ্যে কতো কি যে মনগহনে খেলা করে…
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই খেলাড়গড় ছেড়ে পৌঁছনো গেল রাজবংশের অন্য আর এক দুর্গ ধুমসাইয়ের পাশে চন্দ্রকেতুগড়ে। রাজার নামে গড়,স্বাভাবিক ভাবেই, বিশালাকৃতি,ঘনপরিখা-সমৃদ্ধ এই গড়টিও মাকড়া পাথরের। গঠনশৈলী নাকি ছিলো চমৎকার, বহুব্যয়ে,বহুশ্রমিকের আয়াসে প্রস্তুত , ঘনবনমধ্যে হয়তো সুরক্ষার জন্যই গড়টি ছিলো একতলা, কোন সিঁড়ি বা দ্বার নেই, আক্রমনকালে শত্রুপক্ষকে গোলকধাঁধায় ফেলার কৌশলেই কি!
যদিও পদাধিকার বলে, এইসব রাজা ছিলেন মারাঠা অধীনস্থ সামান্য পাইক, তবু আভিজাত্যে, জাঁকজমকপূর্ণ প্রতিষ্ঠায় তাঁরা রাজার সমতূল্যই ছিলেন। এই সব ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে অনুভব করা যায়, পরবর্তী চূয়াড়বিদ্রোহের সময়, ইংরেজ পাইকদের অধিকার হরণ করায় কেন জাত্যাভিমানে লেগেছিলো তাঁদের! কেন দলে দলে যোগ দিয়েছিলেন সেই যুদ্ধে!...
হঠাৎ কেমন যেন স্বপ্নোত্থিত কন্ঠে অরূন্ধতী বলে উঠলেন,
-হয়তো আমরাও কোন একদিন পুজো দিতে যেতাম দাসী সমভিভ্যরে প্রতিদিন, হয়তো আমাদেরও দিন শুরু হোত সহস্র লিঙ্গ দেবের পূজায়।
হয়তো পড়েছেন আগেই কোথাও, তবে সেই মুহূর্তে সবারই যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হো'ল, আমরা সবাই হয়তো কোন না কোন সময়ে আত্মানুসন্ধানে অতীতচারী হতে ভালোবাসি, ভিজে ভিজে ছায়া ছায়া সেই সব অবচেতন স্মৃতি আমাদের পৌঁছে দেয় এমন কোন ভগ্নমন্দিরে,প্রাসাদ দালানে, মনে পড়ে, বা হয়তো পড়েও না, কার সাথে কে যে দুলেছিলো ঝুলনায়, কার মঙ্গলে কে করতো শিবরাত্রি ব্রত!.....
দেখা হলো মন্দির, পাশ্ববর্তী ইঁদারা, বিশাল সহস্র শিবলিঙ্গ, নাটমন্দিরের সুবৃহৎ ঘন্টা; গল্পে আছে, কালাপাহাড় নাকি এই শিবলিঙ্গ উৎপাটনে, দড়ি বেঁধে সাতটি ঘোড়া দিয়ে টানিয়েছিলেন, পাথরের দালান ফেটে যায়, ঠাকুর নড়েনও না। চন্দ্রকেতুগড় থেকে মাটির তলার সুড়ঙ্গ দিয়ে যাতায়াত ছিলো রানীদের, পূজা নিমিত্তে আসতেন প্রত্যেক প্রভাতে; অবিচল ঠাকুরও কি প্রত্যাশায় থাকেন ভক্তের অর্ঘ্যের, এভাবেই! কে জানে!...
পাশের তেঁতুল গাছের তলায় বসে গুটিকয় রাখালছেলের সাথে খানিকক্ষণ চললো একালের গল্প, ইস্কুল,পড়াশোনা, করোনা…,শোনা হলো ওদের বাঁশি। একেবারেই নিজস্ব, রাখালিয়া সে মেঠো সুর সামনের রৌদ্রস্নাত ধু-ধু প্রান্তরে পাক খেতে খেতে কোন এক মায়াকুন্ডলীর মতো কোথায় যে কোথায় হারিয়ে গেল, সুরাবিষ্ট তাঁরা টেরও পেলেন না। বিদায়বেলায় ওরা পেল সঙ্গে থাকা কেক-মিষ্টি, বিনিময়ে তাঁদের সন্তানেরা পেল বাঁশের বাঁশি।
এদিকে বিকেল হয়ে আসছে, ট্যুরপ্ল্যান অনুসারে,পৌঁছনো গেল, 'কুসমাদিঘী'র পাড়ে, একটু দূরেই 'রক্তিয়াকুঁড়'। নয়াগ্রাম রাজবংশের সবচাইতে হৃদয়বিদারী উপকথার দ্বারে।
রামায়ণ বর্ণিত সেই বিখ্যাত মান্ধাতা কিনা জানা নেই, তবে ছিলেন বটে এক রাজার মতো রাজা, আমাদের এই জঙ্গলমহালেও। দিব্য সিংহ মান্ধাতা, নামেই সুপ্রকাশ তাঁর পৌরুষ-প্রভা। সেযুগে বীরত্ব বলতে যা বোঝায়, গড়রক্ষা অথবা লুটতরাজ, সবেতেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন নয়াগ্রামের এই রূপবান বীরপুরুষ। গহনবনমধ্যে, উচ্চাবচ বিপদসংকুল পথে, দ্রুতগামী অশ্ববিহারে, প্রজাপালনে, রবিনহুডগিরিতে, তাঁর তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। কিন্তু রাজধর্মপালন ছাড়াও পুরুষের মন তো আরও কিছু চায়! 'হে অজানা, তোমায় তবে জেনেছিলেম অনুভবে…' ; লোকমুখে একালের অরূনেশ্বরের কাছে এসে পৌঁছলো চিরবাঞ্ছিতা কমলিকা-সংবাদ, না দেখেই, কোন এক অমোঘ আকর্ষণে, 'কার যেন বীণার গুঞ্জরণ আকাশে মেলে দেয় অন্তহীন অভিসারের পথ';
তৃষিত মনপাখিটি আশ্রয় চাইলো পাশ্ববর্তী দীপা-কিয়ারাচাঁদ রাজকন্যা রাউতমনির আঁচলছায়ায়। কিন্তু কন্যার পিতা বীরশ্রেষ্ঠ কালুভুঁইয়া বা মাতা কুসুম একেবারেই অনাগ্রহী, এদিকে প্রনয়ীমন প্রিয়া পিয়াসে অধীর; পুরুষের অপেক্ষা যে আর সয়না।
শত অনুরোধ-উপঢৌকনেও যখন ফললাভ হয়না, প্রেমিক ধরলেন অস্ত্র; অন্তরের তন্তুতে তন্তুতে জেগেছে পৌরুষ; প্রেমে-যুদ্ধে অনৈতিক কিছুই নেই, অতর্কিতে আক্রমণ করলেন দীপাকিয়ারাচাঁদ;
কোন এক অপরূপ সন্ধ্যায় কুসমাদিঘীতে তখন নৌকা-বিহারে রত কন্যাসহ রাজপত্নী, অকস্মাৎ কুসমাদিঘী ঘিরে ফেলেন রাজা দিব্য। খবর পেয়েই কালুভুঁইয়া আসেন স্ত্রী-কন্যা রক্ষায়, সাতদিন ধরে চলে মরনপন লড়াই; যুজুধান দুইপক্ষে মারা গেল অসংখ্য যোদ্ধা, তাদের রক্তে জন্ম নিলো এক কুন্ড 'রক্তিয়াকুঁড়', অবশেষে বীরের মৃত্যু কালুর। সদ্যস্বামীহারা রাণী জলে ডুবে মরলেন, নবীনা কন্যার সে সাহস হয়নি, ফলস্বরুপ, নিজরাজ্যে নিয়ে এসে, সসম্মানে বিবাহ করেন রাজা রাজকন্যা রাউতমনিকে।
প্রথম কয়দিন হয়তো কেটেছিলো বেশ, কিন্তু প্রতিটি সন্ধ্যায়, নদীপারের বাতাস রাজকন্যাকে নিয়ে যায় পিতৃগৃহে, মনে পড়ে নৌকাবিহার,সেই ভয়াবহ যুদ্ধ, পিতা-মাতার অকাল মৃত্যু; যে মৃত্যুর কারণ তাঁর রূপ আর তাঁর প্রণয়ী! নিমেষে বিবশ হয়ে পড়েন, কন্যাজন্ম-ঋণ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে প্রেমে, সমর্পণে; রাতের পর রাত কাটে বিরহদহনে।….
অবশেষে একদিন চোখে পড়ে বীরের, রাণী আকুলনয়নে তাকিয়ে আছেন গবাক্ষপথে। ঈর্শা বা সন্দেহ পুরুষের জাতধর্ম, ভুল তো মানুষ মাত্রেরই হয়, উগ্রচন্ডা প্রেমিকও এমনই কোন এক গোধুলিবেলায় করে ফেললেন এক মারাত্মক ভুল, গৃহে এসে হত্যা করলেন প্রাণের ধনটিকে; যে স্বপ্নের লালনে কেটেছে বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণ, চন্ডাল রাগে নিজহস্তে, নিধন করলেন তাকে। পরে এলো তীব্রতর অনুশোচনা, রাজধানী নয়াগ্রাম থেকে কুলটিকরীতে নিয়ে আসা শুধুমাত্র রানীর স্মৃতিরক্ষায়...কিন্তু সেসব তো এক অন্য গল্প। রণডাঙার রক্তিয়াকুন্ড,কুসমাদিঘীর অতল কালো জল আজও সেই অতৃপ্ত প্রেমাকাঙ্খী যুগলের মন্দভাগ্যের আকুলতা পৌঁছে দেয় একালের দরদীর মনে মনে।
এদিকে দিনসমাপন হতে চললো, অপরিচিত বনমধ্যে আর থাকা নিরাপদ নয় ভেবে তাঁরা সবাই চললেন হাতিবাড়ির উদ্দেশ্যে, বাংলা-ঝাড়খন্ডের সীমান্তে যেখানে পাথর ফাটিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতি বলয়ে উত্তর থেকে পূর্বে প্রবাহিনী সুবর্নরেখা, এই জঙ্গলের প্রাণের সই, চিরদিনের মিতা।
চিত্র- লেখিকা
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
2 Comments
মুগ্ধতা....!!!!!
ReplyDeleteঅনবদ্য কলম।
ReplyDelete