মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৬২
বিধুভূষণ জানা (চিকিৎসক, উদ্ভিদ প্রেমী, নন্দকুমার)
ভাস্করব্রত পতি
আলোছায়া এখানে নিশ্চিন্তে খেলা করে সবুজ পাতার ফাঁকে। দু'দণ্ড জিরোতে চাইলে এখানে এলে মনে হবেই অন্য ভুবনের আস্বাদন। এই ‘মানুষ রতন'-এর স্নেহস্পর্শে তাই ভয়ঙ্কর রকম প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে নানা ধরনের গাছ। সবুজ গাছ হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনের চলমান সংস্কৃতি। তাঁর মননে সবসময় তান ওঠে --
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি"!
নগর সভ্যতার অন্তরালে আজ হারিয়ে যাচ্ছে গাছ গাছালি পাখ পাখালি আর শাখ শাখালি। কমে যাচ্ছে ‘জীবন বায়ু' অক্সিজেন। বাড়ছে দূষণের মাত্রা। মৃত্যুর প্রহেলিকা গ্রাস করছে এই প্রকৃতিকে। এই উপলব্ধি আজ যে ক'জনের হয়েছে তাঁদের মধ্যে একজন হলেন অত্যন্ত অনালোচিত 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' বিধুভূষণ জানা। পরিবেশের অবমাননা থামাতে নিজের বাড়িটাকেই করে তুলেছেন অক্সিজেন তৈরির আঁতুড়ঘর। নন্দকুমারের রামভদ্রপুরে তাঁর সবুজ মাখা বাড়িটায় আজ গাছেদের অবাধ বিচরণ। শাস্তির প্রতিষ্ঠান। বেঁচে থাকার ও বাঁচিয়ে রাখার অমোঘ আকর্ষণ।
সংখ্যার দিক দিয়ে অ্যাডেনিয়ামের গাছ আছে ২০০ এর বেশি। তবে তিনি 'ব্যবসা' করেননা। গাছ বেচার 'নার্সারি'ও তাঁর নেই। তিনি গাছের সাথে ‘প্রেম’ করেন। গাছপ্রেমীদের সাথে ‘সখ্যতা' গড়েন। গাছ বিরোধীদেরকে গাছের প্রতি ভালোবাসতে আগ্রহী করে তোলেন। ২৭ রকমের অ্যাডেনিয়াম গাছের সম্ভার তাঁর জিম্মায়। যা বেশ চাঞ্চল্যকর। তিনি চান এই অ্যাডেনিয়ামের প্রজাতির সংখ্যা ৬০ এ নিয়ে যেতে। রয়েছে অসংখ্য সাইকাস গাছের প্রজাতি।
পেশায় তিনি একজন প্রথিতযশা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। নেশায় বৃক্ষপ্রেমী। নিজে তৈরি করেন গাছ। তবে যে সে গাছ নয়। অত্যন্ত নামী দামী গাছ। যথার্থ বাগানপ্রেমীদের জন্য তা দান করেন। বাড়িতে সবসময় রোগীদের ভিড় লেগেই থাকে। তারই ফাঁকে গাছ প্রেম। গাছ নিয়ে নিত্য চর্চা। নিজেই তৈরি করছেন নানা ঔষধ। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র গাঁতাইত এবং মানস জানাকে গুরু বলে মানেন তিনি। পরম লালিত্যে যত্ন আত্তি করে চলেছেন ক্লোরাফিল পূর্ণ এই 'নির্বাক বন্ধু'দের। তিনি মানেন, এজন্য বেইমানির খপ্পরে পড়তে হবেনা তাঁকে। গাছের সাথে সখ্যতা করে পৃথিবীর কেউ কোনোদিন হয়রানির শিকার হয়নি, মানসম্মান হারায়নি। বরং পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ সবুজ ও সতেজ রাখতে যারা নিত্য ব্যস্ত তাদের মধ্যে 'একমেবাদ্বিতীয়ম' হল গাছ। আর এই ধারণাটুকু সবার মনে বদ্ধমূল করে তুলতে তিনি চেষ্টার অন্ত রাখছেন না।
তাঁর উপলব্ধি, মানুষ মানুষকে ঠকাতে পারে। কিন্তু গাছ মানুষের ক্ষতি করেনা কখনও। তাই তিনি চান বাগান বানাতে। প্রতিটি বাড়িতে থাকুক একটি করে বাগান। ‘গার্ডেন কালচার' এর ধারণাটিকে উস্কে দিতে নিত্যদিন প্রচেষ্টার অন্ত নেই বিধুভূষণ বাবুর। বিধুবাবুর বাড়িতে টব রয়েছে প্রায় হাজার খানেক। নানা ধরনের গাছে ঠাসা টবের সিক্ত মাটি।
তিনি নিরামিষ খান। পারিবারিকভাবে তিনি শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের দীক্ষিত। বাড়ির পুকুরে অসংখ্য মাছ। না, কোনও দিন তা খাওয়ার কথাও ভাবেননি। আসলে 'অহিংসা' নীতির সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চেয়েছেন তিনি। তারই প্রতিচ্ছবি বিধুবাবুর পুকুরের মাছের মধ্যেও সঞ্চারিত যেন! তুলসিপাতা ছিঁড়ে পুকুরে ফেললে রেহাই নেই। গপাগপ সাবাড়! তুলসি পাতাও চলে যায় মাছেদের পেটে!
পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো চর্চা হল— 'বনসাই চর্চা'। সেই চর্চাতে যাঁরা যুক্ত থাকেন তাঁরা কখনই পরিবেশের ক্ষতি চাননা। তাই তিনি মানুষজনকে আগ্রহী করে তোলেন বনসাই চর্চার সাথে। বাগান চর্চার সাথে। গত ৩০ বছর ধরে বাগানচর্চার সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন এই ডাক্তারবাবু।
তাঁর বিশ্বাস, প্রথমে 'সুন্দর' গাছকে ভালোবাসতে শিখতে হবে। তবেই ‘অসুন্দর' গাছকেও ভালোবাসতে পারা যাবে। বিধুবাবু তাই অনায়াসে বলেন— 'যদি একদিনের সুখ চান তবে বিয়ে করতে হবে। যদি কয়েকদিনের সুখ চান তবে ভ্রমণ করতে হবে। যদি সারা জীবনের সুখ চান তবে গাছ লাগাতে হবে'।
1 Comments
একটা বড় গাছের সম্ভাবনাকে নির্মমভাবে কেটে ছেঁটে বনসাই তৈরি করাকে বৃক্ষপ্রেমের নিদর্শন বলে আমি মনে করিনা।
ReplyDelete