বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়
নির্মল বর্মন
১৯৬১-তে "মানবমন" নামক পত্রিকার প্রকাশক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় একাধারে ডাক্তার,নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক ছিলেন। এহেন ব্যক্তিত্বের অধুনা বাংলাদেশের খুলনায় ১৯১১ সালে জন্ম। ডা.ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য ভারতের প্রথম পাভলভীয় সিস্টেমে মনোরোগের সুচিকিৎসার গোড়াপত্তন করেন। এশিয়া মহাদেশে সন্মোহন অভিভাবন প্রয়োগ করে চিকিৎসা ব্যবস্তার যুগান্তর ঘটিয়ে ছিলেন। বস্তুতঃ ডা.ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় "পাভলভ ইনস্টিটিউট"(১৯৫১) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৮ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ডা. ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মনোরোগ চিকিৎসা বিষয়ে লেখা কয়েকটি গ্রন্থ:---
"বিচ্ছিন্নতার ভবিষ্যৎ" (২ খণ্ড), "পাভলভ পরিচিতি", "শৈশব ও তার সমস্যা", "কৈশোর ও তার সমস্যা" ,"বিশ শতকের শেষ দশকের চিন্তাভাবনা" ইত্যাদি। ডা.গঙ্গোপাধ্যায় "কৈশোর ও তার সমস্যা" গ্রন্থের জন্য "রবীন্দ্র পুরস্কার" এ ভূষিত । ১৯৭৭-এ তুখড় চিকিৎসা সাহিত্যিক হিসেবে "সোভিয়েট ল্যান্ড নেহেরু পুরস্কার" এ ভূষিত। '
নাট্যকার ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় নাট্যগ্ৰন্থ :-- "মরুঝঞ্ঝা", "স্ত্রীচরিত্র", "সম্রাট", "যুগান্ত", "নিউট্রন","অপারেশন ফাউস্টাস",ও "লেনিন সরণি" ।
নাট্যকার সাহেব বোমা ও বিশ্বশান্তি নিয়ে লেখালেখি করলেন "অপারেশন ফাউস্টাস" এবং মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দলগুলির ক্রমবিভাজন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখি "লেনিন সরণি" নাটক । ১৯৬২ তে নাট্যকার গঙ্গোপাধ্যায় নাট্যজগতে বিশেষ অবদান ও সমাজ কল্যাণের জন্য "গিরিশ পুরস্কার" এ ভূষিত।
প্রাবন্ধিক ও ডাক্তারবাবু গঙ্গোপাধ্যায় "ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল", "এশিয়াটিক সোসাইটি", "ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন" ও" ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটির সদস্য" এবং "ইন্দো-সোভিয়েট কালচারাল সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সুযশের দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
প্রাবন্ধিক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বিচ্ছিন্নতা কাকে বলে?বিচ্ছিন্নতার উৎস সন্ধান, কারণ ও প্রতিকার বিষয়ে সময়োপযোগী মূল্যবান রচনা টি হলো নাম প্রবন্ধ "বিচ্ছিন্নতার ভবিষ্যৎ"। প্রবন্ধের প্রারম্ভে প্রাবন্ধিক সময়োপযোগী সময়ের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখে ফেলেন--
"মন্দির, মসজিদ, গির্জার চত্বরে ভিড় বাড়ছে বটে, কিন্তু আশ্রয় মিলছে না। অজস্র প্রশ্ন জাগছে, উত্তর দেবার গুরুদেবের অভাব। সমস্যা অনেক, সমাধানের ইঙ্গিত নগণ্য। ... প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকেই ইয়োরোপের বুদ্ধিজীবীদের মনে এ অভিযোগ জমে উঠেছিল; আজকে এর প্রাবল্য ও বিস্তৃতি-দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে।"
বস্তুতঃ প্রাবন্ধিক বিচ্ছিন্নতার স্বরূপ সন্ধান মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:-
"সমাজজীবন ও ব্যক্তি জীবনে নিদারুণ সংকট দেখা দিয়েছে, বিচ্ছিন্নতা ও শূন্যতাবোধ ব্যক্তিকে জীবনবিমুখ করে তুলেছে, মানবিক সম্পর্ক দূষিত হয়েছে, পারিবারিক সম্পর্কে ভাঙন ধরেছে, সামাজিক ও নৈতিক মান নেমে এসেছে, মানবিকতার মর্যাদা ছেড়ে দ্রব্য ও অর্থের মর্যাদাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।"
প্রাবন্ধিক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তাই এ প্রসঙ্গে বক্তব্যটি হল:--
"সম্প্রতি গল্প উপন্যাসের নায়কদের মধ্যে তাই বারবার 'আউটসাইডার'-এর দেখা মেলে"।
প্রাবন্ধিক মানুষের সমাজজীবনেও লক্ষ করেছেন একই বিচ্ছিন্নতার নানাদিক। ডা.ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য তাই বিশ্লেষিত:-
"খণ্ডিত সত্তার প্রতিফলন দেখছি শুধু সাহিত্যিকদের লেখায় নয়, মানুষের জীবনেও। দ্বন্দ্ব ও বিরোধিতা জীবনকে অস্থির করে তুলেছে।-----------।পজিটিভিস্টরা ম্যাক্-এর দেউলিয়া তত্ত্ব নবকলেবরে হাজির করেছেন। একশো বছরের পুরানো কিয়েরকে গার্ড- এর অস্তিত্ববাদ তত্ত্ব জেসপার, সাত্র, মারসেল, কামু প্রমুখের দৌলতে নতুন জৌলুস নিয়ে জ্বলে উঠেছে।"
প্রাবন্ধিকের প্রবন্ধে শুধু দার্শনিক তথ্যে ভরপুর নয়, ধর্মজীবিদের মধ্যেও বিচ্ছিন্নতাজনিত চাঞ্চল্য দানা বেঁধেছে। প্রাবন্ধিক তাই এই প্রসঙ্গে যত্নসহকারে জানিয়েছেন:---
"ধর্মরাজ্য পুনঃস্থাপনের আশায় এঁরা মেতে উঠেছেন। নতুন ধর্ম, নতুন দুর্গ গড়বার আশায় পশ্চিমি পণ্ডিতগণ ইস্টার্ন মিস্টিকদের জীবনী লেখায় মনোনিবেশ করেছেন। বিজ্ঞানযুগের মিথ্যা অভিমান ছাড়বার জলে মানুষকে পরামর্শ দিচ্ছেন।"
বর্তমান সময় ও সমাজে 'নীতিবোধ ও মানবিকতা'র উন্নতি হচ্ছেন বলেই প্রাবন্ধিক সমকালীন সামাজিক অবস্থান গ্ৰহনযোগ্য:--
"কালোবাজারি ও ঘুষখোরের আধিপত্য সমানে বেড়ে চলেছে, অ তেমনি বেড়ে চলেছে একচ্ছত্র পুঁজিবাদের ব্যাদানবিস্তার। সেই বিস্তার সঙ্কুচিত কর ব্যবস্থা অনেক রাষ্ট্রের সংবিধানে থাকলেও তাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। দে যাচ্ছে, এ সব বিধিবিধান ও প্রতিষ্ঠান অন্য এক যুগের জনকর্ম ও অভ্যাসকর্মের ওপ গড়ে উঠেছিল, এ যুগের সমস্যা সমাধানে তারা অপারগ।"
প্রাবন্ধিক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বিশ্বব্যাপী বিচ্ছিন্নতার কারণ অনুসন্ধান করে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। ফলতঃ কারণগুলি হল:--
১.প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর হতাশা এবং অস্থিরতা।
২. ফ্রয়েডীয়:ভাবনায় প্রসার যা মানবতাবোধকে আঘাত হানার।
৩.'অ্যাডলারের ক্ষমতাসর্বস্বতার মানুষকে, মানুষের সমস্যাকে অন্যদিকে মোড় ঘুরিয়ে দিল'।
৪.এরিক ফ্রম-এর বাণী:-- "ধনতন্ত্র মানুষকে দিয়েছিল মুক্তি, দিয়েছিল স্বাধীনতা, কিন্তু সে মুক্তি মানুষের সইলা তাই সে স্বেচ্ছায় ফ্যাসিবাদের একনায়কত্ব বরণ করে নিয়েছে"।
৫.মীড-এর বাণীওৎ প্রসারযোগ্য:--"যেখানে শিশুর জীবনের প্রাথমিক পর্বের উপাদানগুলির (nursing, wear toilet training and infant feeding) বিশৃঙ্খলা ঘটলে মানুষ অসামাজিক মনোবিকারগ্রস্ত হতে বাধ্য"।
প্রাবন্ধিক "গত কয়েক বছরের বৈজ্ঞানিক আবিষ্ক্রিয়া ও ব্যক্তিজীবনে অভূতপূর্ব প্রভাব বিস্তার করেছে।”
কারণ-
১. ''আণবিক বিস্ফে আয়ত্তে আনতে পারার ফলে অমিত শক্তির অধিকারী আজ মানুষ।''
২."ইলেকট্রনিক্স দ্রুত উন্নতির ফলে যান্ত্রিক স্বয়ংক্রিয়তা আজ সহজ, সুলভ। সামনে নতুন দিগন্ত উদ্ভাসিত যার আভাসে আজ মানুষ মাত্রই চঞ্চল।"
৩. "কারিগরি ও বিজ্ঞানশিক্ষার নতুন পাঠক্রম তৈরি হচ্ছে দেশে দেশে"।
৪. শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে "মানুষের পুরানো শিক্ষা যে মানসিকতা ও হৃদয়বৃত্তি গড়ে তুলেছিল, সেগুলো নতুন শিক্ষার সংঘাতে ভেঙে পড়ছে। মানুষের বিপুল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের সুস্পষ্ট নির্দেশ আজ কোনো কৌশলেই গোপন রাখা যাচ্ছে না।"
🍂
আরও পড়ুন 👇
বর্তমান সময় ও সমাজের প্রেক্ষিতে প্রাবন্ধিকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত:-
“নতুন সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ আজ স্তম্ভিত। অতীত বর্তমানের চিন্তাভার পিষ্ট, নিরাপত্তাহীন জীবনের উপযোগী মানসিকতা ও হৃদয়বৃত্তি ভেঙে পড়ছে, কিন্তু কল্যাণময় ভবিষ্যৎ সৃষ্টির উপযোগী মানসিকতা ও হৃদয়বৃত্তিও গড়ে উঠছে না। বাধা দিচ্ছে অতীতের প্রেত- মালিকানার স্বার্থ আর সেই স্বার্থপুষ্ট কৌশলী অপপ্রচার"।
ডা.অদ্রিজা বর্মন ভিনরাজ্যে "ডা.ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়" বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক সেমিনারে বলেছিলেন:- ---
"ডা.ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সুতরাং মনের জ্বালা যন্দ্রনা অনুভব করা স্বাভাবিক। কিন্তু ডাক্তার ও প্রাবন্ধিক গবেষক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সত্তর আশির দশকে যে সব মন্তব্য করেছেন তা আজকে ভারতের বিভিন্ন পথে প্রান্তে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে "।
প্রাবন্ধিক মূলতঃ বিচ্ছিন্নতার প্রতিকার সবসময় আশা করতেন , বিষয়টি কীভাবে সম্ভব? তা জানাতে গিয়ে কয়েকটি পথের কথা বলেছেন। সেগুলি হলঃ:--
১. "জাতিসংঘ গঠনের ফলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে"।
২.বিশ্ববাসীর শান্তিকামী মানুষেরা বিশ্বশান্তির জন্য সোচ্চার ।
৩."আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার জন্য আন্দোলন ও সদিচ্ছা বাড়াতে অবশ্যই হবে"।
৪. বিশ্বের মানুষ পর্যটনের বিকাশে
পরস্পরকে জানবার ও বোঝবার প্রচুর সময় ও সুযোগ পাচ্ছে।
৫."বিভিন্ন দেশের দাননীতির ফলে দাতা গ্রহীতা দেশের মধ্যে সম্বন্ধ সাধারণ মানুষকেও প্রভাবিত করছে"।
৬. জাতীয় ক্ষেত্রে প্রথমসারির দেশগুলির "জনসাধারণের এক বিরাট অংশের মধ্যে একচ্ছত্র পুঁজির বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে"'।
প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ডা.ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রগতির অন্তরায় প্রেক্ষিতে লক্ষ করেছেন:--
"নতুন সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবার জন্যে যে মানসিকতা ও মূল্যমানের প্রয়োজন, মানব চরিত্রে ধীরে ধীরে তারই উন্মেষ ঘটছে।"
বস্তুতঃ ডা.ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বড় মাপের সাহিত্যিক হওয়া সত্ত্বেও কালের অমোঘ নিয়মে আজ প্রায় বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক।
2 Comments
ভালো লাগলো, এই সব স্পষ্ট ভাবে চোখে পড়লে পড়বার ইচ্ছে জাগে একটু সময় নিয়ে পড়তে হয়, পড়লাম অজানা জানলাম। রাইটারকে ধন্যবাদ
ReplyDeleteঅনেকঅজানা তথ্য পড়ে খুবভালোলাগলো। নিজে সমৃদ্ধ হলাম। লেখকের পড়ার অপেক্ষায় রইলাম। 🙏🏻👍
ReplyDelete