জ্বলদর্চি

পাঁচটি কবিতা || জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়


 পাঁচটি কবিতা
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় 
  
 হাত  

কখনো সীমানা পেরোইনি
আসলে আমার দেহ কখনো সীমানা পার হয় নি
আমার বাপ-ঠাকুরদা-বড়োবাবা বা বংশের কেউ
ওপারে ছিলেন এমন ইতিহাস নেই
আমি জাতিস্মরও নই তাহলে এত টান কেন?

সীমানা বলতে আমি বুঝি ভেদ ও ভাগের পাঁচালি
কাঁটাতার দুর্গম যাত্রা ডিঙি নৌকোর যাতায়াত
আর অবৈধ শব্দের কালো অক্ষর
নিষিদ্ধ ফলের মতো,নিষিদ্ধ পাঁচিলের মতো
উত্তেজক জানালার মতো দুর্দম টান
তাকে এড়ানো যায় না,মাড়ানো যায় না,পারানো দুষ্কর 

কাহিনি শুনতে শুনতে বাঁধে গল্পের চাক
তাতে জমে মধু আর ক্ষীর বাদল রাতের ধারা
নৌকোর ছপছপ সবুজের ঢেউ মেঘনদীর বিক্ষোভ
আতঙ্ক আর আগুন..... 

এখন আর শরীর পোড়ে না,মন পোড়ে
মনে হয় দমবন্ধ জলে,ডুবিয়ে দিচ্ছে কোনো ছায়াহাত ! 



ধনুক   


কৌতূহল ও তৃপ্তি আশা আনন্দের আশ্বাস
কিছু দখিনা পাগল আগুন দেখেই হাসে
গিলে নেয় কিছুটা প্রলয় তবু কিছু সুখ জাগে
তীব্র ডানার পতঙ্গ মিলনের বার্তাটুকু লেখে 
যে আসলে নিজেকে পোড়ায় ভেতর হুতাশে
প্রতিদিন লিখে রাখে দোল রং ও উল্লাস
মগজের ভাঁজে ভাঁজে খাজুরাহো গাঁথা
মূর্ত ভাস্কর্যে সভ্যতার লুকোনো সম্পদ
কতদিন আড়াল বুনে বুনে দাহ্য পাতাকে বলো
বিশ্বাসের কথা আগুন কি অন্ধকার মানে ? 

সংগীত  


কদিন সুখে ঘুম ভেঙে ওই পলাশবীথি 
ডাকছে চাঁদের আলোর ফাগে মগ্ন ফাগুন।
পাহাড়-টিলায় আগুনরঙের বন্যা লাগে
পতঙ্গেরা খবর ছড়ায় গুনগুনিয়ে 
দল বেঁধে যায় দামালগুলো পরাগ মাখে।
ফাগের মতো পাথরমাটির নরমধুলো
রসকলি দিচ্ছে এঁকে বাউলসখা 
সরল চোখে তাকিয়ে থাকে মানুষ দেখে
রুক্ষডাঙার গভীরে রস কষ্টে পাওয়া
সন্ধ্যে হলে অতীত দিনের কথায় মাতে
বাতার আসন যায় টলে জোর ঝুমুরগানে।
রসিকজনা ঠিক বেঁধেছে কথায় সুরে
এত আলো এত মায়া ছড়িয়েছে কে? 
ফাগুন আসে আপন মনে ধু-ধু মাঠে
মাঠের বুকে কান পাতি ওই ঝড় উঠেছে।



সানাই    

ইমনের পর হোরি ধরলেন গুরু বিসমিল্লা খান
মুখে সেই অদ্ভুত মায়াবী হাসি শান্ত ও উদার
বুক থেকে ভালোবাসা সুবর্ণ তরল হয়ে
বয়ে যায় ভেদবুদ্ধিহীন কলুষনাশিনী স্রোতে
সুরের উদারতা দিব্য গড়িয়ে নিম্নভূমি দিশা
সেই সুধা আকণ্ঠ গিলে কিছু বিষাক্ত রস
হারিয়ে ফ্যালে হননসুখ,সুধাভাণ্ড ছুঁয়ে
অমৃতের গন্ধ গলি ও পুলিনে ভাসে 
পারিজাতময় পরম শান্তি মাখে হোমোগণ 

যিনি প্রথম আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন তিনি কি
জানতেন প্রয়োজন কোনোদিন ভয়ংকর হবে ? 


ছায়া  


দূর পথ হেঁটে যাই একা।
বুঝি,সঙ্গে কেউ হাঁটে কিন্তু দেখতে পাই না
এপাশ ওপাশ পিছন.... ভৌতিক শূন্যতা
একা মানুষ আধ-সমকোণে সূর্য ঢলে যায়
দুটো ছায়া হাঁটে।
চৈনিক মুখের মতো বা জঙ্গলের পথের মতো
অবিকল এক
আলাদা করা যায় না।
ছোটো কাপে চা লম্বা টান,ঠোঁট নয়
শুধু দুটো তৃপ্তির শব্দটান।

কথা বলি একা।কে যেন উত্তর দেয়।
আমার চেয়ে ভালো,বেশ মাপা গোছালো
শব্দের ফিতে মাপা উচ্চারণ 
অগ্নীশ্বর টোন খুব চেনা তবু সংশয় -- কে? 
হাঁটে,বলে,গান গায় অথচ সুর ভোলে না
সে-কি গুরু কবির 'জীবন দেবতা'
নাকি প্রিয়বন্ধু,প্রতিরূপ!

চিৎকার করি কে?  কে? 
চৌদিক চুপ।
পাখিরা ফিরে যায় বিশ্রাম ঘরে
বেদনার লূতিকাজাল হেমন্তের ধানখেত টানে
ফড়িংসন্ধানী বালকের মুখ ভাসে কুয়াশায়
কথা বলি একা।ঝিঁঝির তানপুরা বাজে।
ছায়ার আলাপে বুঝি সে আমার ছলনাপুরুষ।


Post a Comment

1 Comments

  1. অসাধারণ, মন প্রাণ ছুয়ে গেল প্রতিটি কবিতাই মুগ্ধ হয়েছি।❤️🌼

    ReplyDelete