জ্বলদর্চি

আলকুশি /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ১

আলকুশি

ভাস্করব্রত পতি

'খাস বাগানে আলকুশি'। এই প্রবাদের অর্থ হল - প্রিয় স্থানে অপ্রিয়ের উপস্থিতি। আলকুশি এমনই এক গাছ, যেটি বাগানে থাকলে শ্রীবৃদ্ধি নয়, শ্রীহীন করে দেয়। আর আলকুশির স্বভাবের লোকজনও যদি জনসমক্ষে মেলামেশা করে, তবে সেক্ষেত্রেও বিপদের সম্ভাবনা থাকে! 

তেঁতুলের মতো দেখতে আলকুশির গায়ে বাদামি শুঁয়োর কারণে বিভৎস চুলকানির উদ্রেক করে। এই ফলের গায়ের লোমগুলিকে 'দয়ার গড়ো' বলে। এই ফল পেকে গেলে ঐ গাছের তলায় যাওয়া যায় না। কেননা সেসময় কোনওভাবে আমাদের শরীরে ঐ লোম লাগলে ভয়ানক চুলকোতে থাকে, আর থোড়া থোড়া হয়ে ফুলে যায়। একসময় গ্রাম বাংলায় যাত্রার আসরে চকোলেট বিক্রেতারা পাউডারের সঙ্গে আলকুশি মিশিয়ে নিয়ে যেত। দর্শকাসনের ভিড়ে বাচ্চাদের দেখলে অল্প একটু লাগিয়ে দিত গায়ে। তখন চুলকুনির জ্বালায় বাচ্চারা কাঁদতে শুরু করত। কেউ জানতে পারতো না কান্নার কারণ। অন্য দর্শকদের খুব ডিস্টার্ব হত। ফলে বাচ্চাদের কান্না থামাতে তাঁদের মা বাবারা চকোলেট বাদাম ভাজা কিনে দিতে বাধ্য হত। আর বিক্রি বাড়তো চকোলেট বিক্রেতার! 

শোনা যায় যে ভয়ঙ্কর এই চুলকানির উপাদানটির পাউডার বানিয়ে ব্যবহৃত হত যুদ্ধক্ষেত্রেও। কৌটায় ভরে প্রথমে এই পাউডার যেত সুইজারল্যান্ড। সেখানে জার্মান সেনাদের উর্দিতে নাকি আলকুশি পাউডার ছড়িয়ে দেওয়া হতো ওস্তাগারের মাধ্যমে। সুইজারল্যান্ড থেকে সেই পাউডারমাখা উর্দি যেত জার্মানিতে। জানা গেছে, ১৯৪৩ এর অক্টোবর মাসে জার্মান নৌবাহিনীর ২৫ হাজার নাবিকের উর্দিতে এই পাউডার মাখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে একটা বিচ্ছিরি দশা তৈরি হয়েছিল তখন। নাৎসি বাহিনীর অন্দরে তখন তুলকালাম কাণ্ড। চুলকাতে চুলকাতে জেরবার। যুদ্ধক্ষেত্রের বদলে সেনাদের স্থান হয় হাসপাতালে। শোনা যায় এরপরে জার্মানদের অন্তর্বাস, বিছানাতেও মেশানো হয়েছিল আলকুশি পাউডার। এমনকি কনডোমেও মেশানোর কথা শোনা যায়। এর ফলে জার্মান সেনারা ভেবেছিল হয়তো যত্রতত্র যৌন সম্ভোগের কারণেই এই চুলকানি হচ্ছে। তখন তাঁরা এ কাজ থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করত! 

আলকুশির বৈজ্ঞানিক নাম - Mucuna pruriens (L)। এটি Fabaceae বা Leguminosae (Pia family) পরিবারের একটি উদ্ভিদ। এই 'Pruriens' শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে। যার অর্থ চুলকানির অনুভূতি। এদের তেঁতুল আকৃতির ফলের খোসায় আছে সেরাটোনিন, যার কারণে চুলকানির উদ্রেক হয়। তাই একে বলে তেঁতুল বিছুটি। বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের লোকেরা বলে নিঙ্গুশ বা লিঙ্গুশ। এটি পরিচিত বিলাই খামচি, বিলাই চিমটি বা বিড়ালের চিমটি নামেও। 

বৈদ্যকরা আলকুশিকে বলে 'আত্মগুপ্তা'! কেননা এটি নিজের বীজকে লুকিয়ে রাখে নরম রোমশ শুঁয়োর আস্তরণে। যে শুঁয়ো অন্যের গায়ে লাগলে ভয়ানক বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। একে 'কপিকচ্ছ'ও বলে। আসলে তেঁতুলের মতো দেখতে আলকুশি ফলের গায়ে এরকম বিষাক্ত শুঁয়ো না থাকলে বানর (কপি) খেয়ে শেষ করে দিত। কিন্তু বানর জানে এর বিপদের কথা। তাই এই ফল গাছে ঝুলছে দেখতে পেলেই বানর সে বন ছেড়ে পালিয়ে যায়। কেননা ঐ ফলের গায়ের শুঁয়োগুলো বানরের গায়ে লাগলেই চুলকোতে চুলুকোতে সে পাগল হয়ে ছুটতে থাকে দ্বিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে। এইজন্যেই এই আত্মগুপ্তার নাম 'কপিকচ্ছ'। 

হিন্দিভাষী অঞ্চলে একে ব'লে কেওয়াজ বীজ। ওড়িশাতে একে বলে বাইডঙ্ক। ইংরেজিতে এ গাছকে বলা হয় ‘ফ্লোরিডা ভেলভেট বিন’, ‘মাংকি ট্যামারিন্ড’, 'মরিশাস ভেলভেট বিন’, ‘বেঙ্গল ভেলভেট বিন’, ‘ইয়োকোহামা ভেলভেট বিন’, ‘ভেলভেট বিন’, Common cowitch,  Cowhage ইত্যাদি। ইউনানী চিকিৎসকরা আলকুশির বীজকে বলে 'তুখ্মে কোঁচ'। তবে চরক সংহিতায় এটিই 'কাকাণ্ডোল' নামে পরিচিত। যা Mucuna utilis Wall। ঔষধ তৈরিতে ব্যবহার হয় এর মূল ও বীজ। 

এই আলকুশি অন্য যেসব নামে পরিচিত, সেগুলি হল - গুপ্তা, স্বগুপ্তা, স্বয়ংগুপ্তা, আত্মগুপ্তা, অজহা, অজড়া, অধ্যন্তা, আর্যভী, শুকপিণ্ডী, শুকশিম্বা, শুকশিম্বী, শিল্পী, কপিপ্রভা, কপিকচ্ছ, কুন্ডলী, কপিরোম ফলা, রোমবল্লী, রোমাল, কীশরোম, চণ্ডা, গুরু, জড়া, তীক্ষ্ণ, দুরভিগ্রহা, দুপর্ণা, ঋয্যপ্রোক্তা, প্রাবৃষায়িণী, প্রাবৃষা, প্রাবৃষেণ্যা,  বহরিকা, বনশূকরী, বানরী, বদরী, মর্কটী এবং মহর্ষভী।
এই গাছটির আদি নিবাস আফ্রিকা হলেও এশিয়াতেও প্রচুর মেলে। উষ্ণপ্রধান দেশে এই গণের (Genus) ২০ টি প্রজাতি (Species) আছে। ভারতেই মেলে ১০টি। ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, পূর্ব নেপালের তরাই অঞ্চল সহ ভারতের সকল বনাঞ্চলে দেখা যায়। আলকুশির যেসব প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়, সেগুলি হল --
Mucuna aterrima (Piper & Tracy) Holland
Mucuna atrocarpa F.P.Metcalf
Mucuna axillaris Baker
Mucuna bernieriana Baill.
Mucuna capitata Wight & Arn.
Mucuna cochinchinense (Lour.) A.Chev.
Mucuna cochinchinensis (Lour.) A.Chev.
Mucuna deeringiana (Bort) Merr.
Mucuna esquirolii H. Lév.
Mucuna esquirolii H.Lev.
Mucuna hassjoo (Piper & Tracy) Mansf.
Mucuna hirsuta Wight & Arn.
Mucuna luzoniensis Merr.
Mucuna lyonii Merr.
Mucuna martinii H.Lev. & Vaniot
Mucuna minima Haines
Mucuna nivea (Roxb.) DC.
Mucuna nivea (Roxb.) Wight & Arn.
Mucuna prurita (L.) Hook.
Mucuna prurita Wight
Mucuna sericophylla Perkins
Mucuna utilis Wight
Mucuna velutina Hassk.
Macranthus cochinchinensis Lour.
Marcanthus cochinchinense Lour.
Stizolobium aterrimum Piper & Tracy
Stizolobium capitatum (Roxb.) Kuntze
Stizolobium cochinchinense (Lour.) Burk
Stizolobium deeringianum Bort
Stizolobium hassjoo Piper & Tracy
Stizolobium hirsutum (Wight & Arn.) Kuntze
Stizolobium niveum (Roxb.) Kuntze
Stizolobium pruriens (L.) Medik.
Stizolobium pruritum (Wight) Piper
Stizolobium utile (Wall. ex Wight) Ditmer
Stizolobium velutinum (Hassk.) Piper & Tracy
Negretia mitis Blanco
Dolichos pruriens L.
Carpopogon niveum Roxb.
Carpopogon pruriens (L.) Roxb.
Carpogon capitatus Roxb.
Carpogon niveus Roxb.
Carpopogon capitatus Roxb.

বর্ষজীবী আলকুশির পাতা অনেকটা ঠিক শাঁখালুর গাছের পাতার মত। একই বৃন্তে তিনটি পাতা বর্তমান। লতাগাছে ও পাতায় সূক্ষ্ম সূক্ষ রোম আছে। অবনত পুষ্পদণ্ড লম্বায় ৭/৮ ইঞ্চি। ফুলের রং গাঢ় বেগুনি। পুষ্পদন্ডে ৫/৬ ইঞ্চি লম্বা গুচ্ছবদ্ধ শুঁটি হয়। আর শুঁটির গায়ের লোমগুলির রং বানরের গায়ের রংয়ের মত। এই ফলগুলি যখন পাকে, তখন বাতাসে এই লোমগুলি উড়তে থাকে। কিছুদিন বাদে ঐ শুঁটি ফল ফেটে বীজগুলি তলায় পড়ে যায়। তার আগে ঐ ফলের কাছাকাছি যাওয়া খুব বিপজ্জনক ব্যাপার। অবশ্য এটি অযত্নসম্ভূত বৃক্ষাশ্রয়ী লতা। কোনওরকম পরিচর্যা ছাড়াই বেঁচেবর্তে থাকে অনায়াসে। মধ্য আমেরিকায় আলকুশির বীজ আগুনে ভেজে গুঁড়ো করে কফির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এজন্য ব্রাজিল সহ অন্যান্য দেশে এর প্রচলিত নাম হচ্ছে 'নেস ক্যাফে'। গুয়েতেমালা তে কেচি সম্প্রদায়ের মানুষ খাদ্যশস্য হিসেবে আলকুশির চাষ করে। তাঁরা সবজি হিসেবে রান্না করে খায়। 

অথর্ববেদের বৈদ্যককল্পের ৭৫।৪১। ৩১২ সূক্তে বলা হ'য়েছে -- 'বাত্রং বীজং নেতুর্মত্তো বুরীত সখ্যমাত্ম গুপ্তাম্। বিশ্বো রায়ঃ ইধ্যতি দ্যুম্নং বুর্ণীত পুষ্যসে'। চরক সূত্রস্থান চতুর্থ অধ্যায়ে বল্যবর্গে ঋষভী নামের উল্লেখ আছে। টীকাকার চক্রপাণি এই 'ঋষভী' শব্দের অর্থ ক'রেছেন শুকশিম্বী বা আলকুশি বা আত্মগুপ্তা। সুশ্রুত বলাধান ও বাজীকরণার্থ মাষকলাইয়ের সাথে এই বীজের ক্বাথ পান করার উপদেশ দিয়েছেন। বাগভট তাঁর 'অষ্টাঙ্গহৃদয়সংহিতা'তে রক্তপিত্তে আলকুশির বীজ ও শাক খাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। চক্রপাণি দত্ত বাতব্যাধি হলে আত্মগুপ্তার মূলের ক্বাথ পান করতে বলেছেন। ষোড়শ শতকের আর একটি গ্রন্থ 'ভাবপ্রকাশ'তে বলা হয়েছে এই আলকুশির মূলের ক্বাথে তুলো বা পরিষ্কার ন্যাকড়া ভিজিয়ে বিবৃদ্ধ যোনিতে লাগিয়ে রাখলে সঙ্কীর্ণ হয়। 

এছাড়াও অল্প বয়সে কুঅভ্যাসজনিত শুক্রক্ষয়ের পরিণতিতে শুক্রতারল্য দেখা যায়। সেক্ষেত্রে আলকুশির বীজ ভেজে খেলে শুক্রের গাঢ়ত্ব ফিরবে। ভগ্নজ রোগে আলকুশির বীজ দুধে ভিজিয়ে বেটে খেলে উপকার হয়। প্রৌঢ়কালে যাঁদের হাত ওপরের দিকে ওঠে না তা হল অববাহক রোগ। এক্ষেত্রেও দারুণ উপযোগী আলকুশির বীজ বেটে খাওয়া। মাংসপেশীগত বাত বা এট্রোপি অফ দি মাশল (Atrophy of the muscle বা Frozen shoulder) এর ক্ষেত্রে আলকুশী বীজ বেটে আধ গ্রাম ক'রে গরম দুধে মিশিয়ে খেলে উপকার হয়। মাসিক ঋতুর সমস্যাতেও আলকুশির বীজ চূর্ণ আধ গ্রাম মাত্রায় খেলে কিছুটা রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আলকুশির বীজ সেদ্ধ করে খেলে রক্তপিত্ত থেকে রেহাই মিলবে। গাছটি বাহ্যিকভাবে ভয়ঙ্কর হলেও মানবসেবায় বেশ উপকারী। 

এই আলকুশি আঞ্চলিক কবিতাতেও সমানভাবে বিরাজমান। সুবর্ণরৈখিক লোকভাষায় ঝাড়গ্রামের লোককবি ভবতোষ শতপথীর কাব্যগ্রন্থ 'আলকুশি'তে রয়েছে মোট ২২টি কবিতা ও ৮টি ঝুমুর গান। এখানে 'আলকুশি' নিয়ে কবিতায় তিনি লিখেছেন --- 
"নাগেই দিমু আলকুশি
  বকর বকর করনে
 ডাহান হাতটা ভাঁগি দিমু
       জাহান বাজি ধরনে।
 তুই ভালা ত মুই ভি ভালা
    উড়াওঁ ধবলা পাইরা
 নুয়া আঁগার নাল বন্ন
      কাচি দিতেই খইরা।
 বন পুড়েঠে মন পুড়েঠে
  শুকেই গেলা গাড়িয়া
 বাংলা কহিনে বাঁগালি মুঁই
 উড়িয়া কহিনে উড়িয়া।
মুঁই জানঁঅ মুঁই ভারতবাসী
  মানুষ জাতির বংশ
 বনবিহারী বাজাওঁ বাঁশি
   বিভেদ মানে ধ্বংস। 
 তিনকাল যাই চারে ঠেকলা
  কতদিন টানমু ঘানি 
মানুষ জাহান্ ঠসরা চারডাল
পদ্মপতরে পানি'।।

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব ভালো গবেষণাধর্মী লেখা!

    ReplyDelete