জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি মালা : ৩৯ / সালেহা খাতুন


শব্দে গাঁথা মণি মালা : ৩৯ / সালেহা খাতুন 

স্বপ্ন ভাঙলেও সব কিছু শেষ হয়ে যায় নি। আসলে স্বপ্নকে আমার প্রভু না বানিয়ে তাকে আমার আজ্ঞামতো চলতে বাধ্য করেছি। আঘাত খেয়ে অটল থেকেছি। জোর গলায় বলেছি - “দুঃখ আমারে দুঃখী করেনি করেছে রাজার রাজা”। পরীক্ষার ফলাফল ইসিজির গ্রাফের মতো এমনই উঠানামা করেছে আমার জীবনে যে তাকে আজ বলেই দিয়েছি ঐ নকল সাজঘরে আর রাজা সাজার বাসনা আমার নেই। হৃদপিণ্ড, স্নায়ু, পেশি সব কিছুকে আমার অধীন রেখেছি। আমার ইচ্ছাশক্তিতে লেগে থেকেছি।

আসলে নম্বর ব্যাপারটা আপেক্ষিক। কেউ দশে নয় পেয়েও সন্তুষ্ট হয় না আবার কেউ দশে চার পেলেই যথেষ্ট ভাবে। তবে এবারের মতো নিজেকে বলেছি আর ডায়েরি লিখো না বাপু। তুমি তো কোনো কিছু গোপন করতে শেখোনি। তোমার লেখা ডায়েরি হাটের মাঝে পড়ে থাকে। তোমার পড়ার ঘরে যে কেউ ঢুকে পড়ে নিতে পারে। হ্যাঁ পরবর্তী কালে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছিলেন একজন। তিনি আমার হবু শ্বশুরমশাই। তিনি বলেছিলেন “তোমার এতো ঘুম পায় কেন বলো তো? প্রত্যেকদিন রাশি রাশি বই পড়ছো আর লিখছো ভীষণ ঘুম পাচ্ছে”। এই রে তিনি আমার ডায়েরি পড়েছেন! মনের রাগ চেপে বললাম রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে লিখি তো তাই।  

সুখ দুঃখ লিখে রাখা ছেড়ে দিয়েছিলাম অনার্স পার্ট টুর রেজাল্টের পর। চুরানব্বইয়ের  উনতিরিশ জুলাইয়ের পর মাত্র একদিন লিখেছি ডায়েরি। সেদিনটা ছিল বিশে আগস্ট। কল্পলোকের এক বাসিন্দা যাঁর গল্প শুনেছিলাম স্যারের কাছে। তাঁকে সেদিন দেহের চোখ দিয়ে দেখলাম। এতোদিন মনের দৃষ্টিতেই আবদ্ধ ছিলেন। আজ একেবারে সামনাসামনি দেখা। ভীষণ আনন্দ হলো। তিনি স্যারের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসমেট এবং বন্ধু । শকুন্তলা দেবী। পড়ান বহরমপুর গার্লস কলেজে। তাঁর ইয়েটসের উপর লেখা একটি বই আমায় পড়তে দিলেন। ওঁর একমাত্র কন্যা ঋকের সাথেও আলাপ হয়। 

🍂
তিনি জন্মেছিলেন কলকাতার আহিরিটোলায়। তার পর চলে যান গৌর লাহা স্ট্রিটে। সেখানেই স্কুলজীবন কাটে।লেডি ব্রেবোর্ণ ও প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়েন। তখনই আমার স্যারকে বন্ধুরূপে পান। স্যাররা পড়েছেন দিকপাল সব অধ্যাপকদের কাছে। তাঁদের মধ্যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথ বিশী,রথীন রায়,হরপ্রসাদ মিত্র,শঙ্করীপ্রসাদ বসু প্রমুখ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।সাহিত্য রসিকরা তাঁদেরকে ভুলতে পারেন না,পারা উচিতও নয়।স্যারের বন্ধুরাও এক একজন উজ্জ্বল মানুষ। শক্তিনাথ ঝাঁ, অজয় গুপ্ত,ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায়, মীনাক্ষী সিংহ প্রমুখ। ১৯৬২ তে এঁরা সব এম.এ. পাশ করেন। স্যারের বন্ধু এবং অধ্যাপকদের সম্পর্কে অনেক গল্প শুনে শুনে নিজেও যেন তাঁদের কাছে পৌঁছে গেছি মনে হতো।

শকুন্তলা দেবী তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন শ্যামল সেনগুপ্ত, নির্মল দাশ ,পার্থ ঘোষ প্রমুখ  সহপাঠীদের কথা। আমার স্যার সম্পর্কে লিখেছেন, “তবে,অন্ধপ্রায় মানুষ শ্যামল সেনগুপ্ত আমার সবচেয়ে নিকট বন্ধু। অত্যন্ত নিরহংকারী তিনি, তেমনি সজ্জন।প্রতি সপ্তাহেই আমরা পরস্পরের কুশল জিজ্ঞাসা করি”। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই এঁদের ঘরানা দেখে। কী উদার মনের মানুষ এঁরা। স্যার তাঁর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন, “আমার ইসলামী কন্যা বলে”। পরে সামাজিক মাধ্যমে শকুন্তলাদির এক ছাত্রী সামসুন নাহারদির সাথে আলাপ হয়। তিনি তাঁকে দ্বিতীয় মা বলে সম্বোধন করেছেন। আশ্বর্য! আমার বিয়ের আসরে আমার বাবা স্যারের পরিচয় দিয়েছিলেন “সালেহার দ্বিতীয় পিতা” বলে। বাবা বলেছিলেন তিনি আমার জন্মদাতা পিতা আর স্যার আমার শিক্ষাদাতা পিতা। সামসুন নাহারদির জন্য শকুন্তলাদির একটি কবিতা পাঠের সুযোগ আমার হয়েছিল।

শকুন্তলাদির লেখা কবিতা...

“বুকের মধ্যে বাঁধ ছিল,
বাঁধ ভাঙল;
আর কেউ না;যার বাঁধ শুধু সে-ই জানলো
বাঁধের থেকে উড়ে এলো একখানি ঢেউ
যার ঢেউ - শুধু সে-ই ছাড়া আর জানলোনা কেউ;
বিকেলবেলার পড়ন্ত আলোয় ঢেউটা তখন
আপন মনেই
ঢেউ ভেঙে এক পাখি হলো
সোনার রূপোর ডানা মেলে
অন্য আকাশ খুঁজতে গেলো।
পাখিটা যার - এক মাত্র সে-ই জানলো
নিভৃত এক দিগন্তে সে চেয়ে রইলো।

পাখি নয়-এক রশ্মি খাঁচায় বন্ধ ছিলো
জ্বলতে নিভতে জ্বলতে নিভতে কোথায় যেন
উড়ান দিল
মেঝের ওপর স্বকীয় তার যা কিছু ছিলো
তারা যে যার ছায়া সাপটে জমাট হয়ে
বসে রইলো।
মানুষটা যে একা একা
সব ঝেড়ে ফেলে
নিজস্ব তার ছায়াটুকুও
কোথায় যেন হারিয়ে গেলো
হারিয়ে গেলো
হারিয়ে গেলো....”

শকুন্তলাদি আজ আর নেই। তিনিও হারিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর লেখা বেঁচে আছে আজও। মানুষ মরণশীল এটা তো সবাই জানি কিন্তু সৃষ্টিকর্ম ও আচার আচরণ অমর হয়ে থাকে।

(ক্রমশ)
সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments