জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে/প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
বৃন্দাবনের দোল               
এয়োবিংশতি পর্ব

শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান এই কাটরা কেশবদেব মন্দির যেখানে শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রনাভ প্রথম শ্রীকৃষ্ণ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। পরের ঘটনাবলী চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এখানেই শেষ নয়। এরপরের ঘটনা শ্রীকৃষ্ণের নামাঙ্কিত এই মন্দির বারংবার নির্মান, ধ্বংস অত্যাচার ও লুন্ঠনের ইতিহাস। কুষাণ যুগের বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষের উপরে পরবর্তীকালে জয়পুরের রাজা মানসিংহের গড়া কংসকেল্লায় খ্রিষ্টপূর্ব এক শতক পূর্বে শাক্যরাজা সৌদাস প্রথম শ্রীকৃষ্ণের মন্দির গড়ে তুললেন। শাক্যরাজাদের যুদ্ধে পরাস্ত করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্য দ্বিতীয় মন্দির গড়ে তুলেন। সেই মন্দির ধ্বংস করেন গজনীর সুলতান মাহমুদ ১০১৮ খ্রিষ্টাব্দে। মথুরার নরপতি কুলচন্দ্রকে পরাজিত করে ২০ দিন ধরে মথুরার সমস্ত মন্দির ধ্বংস করে মন্দিরের সোনাদানা রত্নরাজি লুণ্ঠন করেও ক্ষান্ত হয়নি মাহমুদ শাহ। উপরন্তু নিরীহ মথুরা বাসীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। এরপরে ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা বিজয় পাল দেবের রাজত্বকালে তিনি তৃতীয় বার কাটরা জন্মভূমির উপরে যে সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণ করেছিলেন সেই মন্দির ধ্বংস করেন দিল্লির সুলতান সেকেন্দার লোদী ষোড়শ শতাব্দীতে। আনুমানিক ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব এই কৃষ্ণ জন্মস্থান দর্শন করেছিলেন। সেই সময়ে এখানে কোন মন্দির ছিল না। কেবলমাত্র মথুরার মূল পথ থেকে খানিকটা দূরে অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থানে নির্মিত হয়েছিল আদি কেশবদেব মন্দির। আকবর ও জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে মন্দিরের উন্নয়নের তারা প্রয়াসী হন। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ওরছার রাজা বীর সিংহদেও পুনরায় কাটরাতে চতুর্থবার কেশবদেবের যে মন্দির নির্মাণ করেন সেই মন্দির ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেব ধ্বংস করে কংস কারাগারের পাশে মসজিদ নির্মাণ করেন। এরপরে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে শেষবারের মতো মথুরা আক্রমণ করেন আহমদ শাহ আবদালি এবং মথুরার মন্দিররাজি ধ্বংস করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা মথুরা অধিকার করে কাটরা কেশবদেব মন্দির নিলাম করে দেওয়ার পরে তৎকালীন বারানসীর রাজা পাটনীমল তা' কিনে নেন। ১৯৪৪ সালে বারানসীর সুসন্তান পণ্ডিত মদন মোহন মালব্যের অনুরোধে বিশিষ্ট শিল্পপতি শ্রী যুগল কিশোর বিড়লা কাটরা কেশবদেব মন্দির কিনে নেওয়ার পরে ১৯৫১ সালে 'শ্রীকৃষ্ণ জন্মস্থান সেবা সংঘ' নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করে কাটরাকে তাদের হস্তে অর্পন করেন। বর্তমানের এই সুদৃশ্য মন্দিরটি চেন্নাইয়ের শ্রী রামনাথ গোয়ন্দের দানে সেবা সংঘের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়।         
🍂
                               
সুদৃশ্য মন্দিরটি শ্বেতপাথর ও লাল বেলেপাথরের সংমিশ্রণে নির্মিত। নাটমন্দিরের দেওয়ালে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার রঙিন চিত্রগুলি দর্শনার্থীরের আকৃষ্ট করে। গর্ভমন্দিরের সিংহাসনে বালগোপালের অপূর্ব বিগ্রহ। কেশবদেব মন্দিরের রঙ্গমঞ্চটিও সুবিশাল এক সভামন্ডপ। প্রতি বৎসর জন্মাষ্টমীতে এখানে শ্রীকৃষ্ণলীলা এবং শ্রীরামনবমীতে শ্রী রামলীলা মঞ্চস্থ করা হয়। 
খানিকটা এগিয়ে ডান হাতে হালকা লালরঙের মন্দিরটি ভাগবত ভবন। পাথরের মন্দিরটি ১৮০ ফুট লম্বা ও ১২০ ফুট চওড়া। মন্দিরের শিখর সোনায় মোড়া। বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ভাগবত ভবনের বারান্দায় পৌছালাম। প্রথমেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মন্দির। উল্টোদিকে চৈতন্যদেবের একটি অনন্য সুন্দর মূর্তি। পুরীর মন্দিরে দূর থেকে স্তম্ভে হাত রেখে যেভাবে জগন্নাথ দর্শন করতেন মহাপ্রভু। এরপরে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের শ্বেত পাথরের যুগল মূর্তি। দুজনের মাথার উপর আলাদা আলাদা সোনার ছাতা, মাথায় সোনার মুকুট, কণ্ঠে বহু মূল্য অলংকার এবং পরিধানে উজ্জ্বল রঙের বস্ত্র। বিগ্রহ দুটির দিকে বারবার তাকিয়েও আশ মেটে না। রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের সামনে দুদিকে মহর্ষি শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস ও আদি শঙ্করাচার্যের শ্বেত পাথরের ছোট মূর্তি। রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের এক পাশে রাম-সীতা ও লক্ষণের মন্দির। শ্বেত পাথরের তিনটি অপূর্ব সুন্দর বিগ্রহ। মন্দিরের বাইরে ভরত ও শত্রুঘ্নর ছোটমূর্তি চামর হাতে। এই চত্বরেই দুর্গা মন্দির, শিব মন্দির, হনুমান মন্দির, চৈতন্য মহাপ্রভুর মন্দির দেখতে পেলাম। এছাড়াও ১১.২৫ কেজি ওজনের পারদের শিবলিঙ্গ এখানে বিরাজ করছেন। কাঁচের উঁচু বাক্সে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের একটি মৃন্ময় মূর্তি। মহাপ্রভুর মন্দিরের উল্টোদিকে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর একটি মাটির মূর্তি কাঁচে ঢাকা। কৃষ্ণজন্মভূমি ধ্বংস করে ঔরঙ্গজেব যে লাল বেলেপাথরের মসজিদ গড়ে তুলেছিলেন সেই মসজিদের সামনে গুজরাটের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী গোকুলদাস পারেল ১৯৮২ সালে প্রায় দু' কোটি টাকা ব্যয়ে ভাগবত ভবন নির্মাণ করে দেন। ভাগবত ভবনে জন্মাষ্টমীতে বিরাট ধুমধাম সহকারে উৎসব পালিত হয়। কারুকার্যময় মন্দিরের ব্যাপ্তি যেমন বিশাল তেমনি বৈভবে ভরা। ভাগবত ভবনের সিলিং ও দেওয়ালে ভাগবত গীতার আখ্যান মুর্ত করা রয়েছে।                              
কাটরা কেশবদেব মন্দির থেকে পনেরো মিনিট হেঁটে যাওয়ার পরে যমুনার তীরে বিশ্রান্তি ঘাটের থেকে সামান্য দূরে ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে গোয়ালিয়রের শেঠ গোকুল দাস পারেখ দ্বারকাধীশ মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের স্থাপত্য কলা ও শিল্পসুষমা দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মন্দিরের গর্ভগৃহে শ্রী দ্বারকাধীশের মনোহর চতুর্ভুজ, শ্যামল বরন মূর্তির চার হাতে শঙ্খ চক্র গদা ও পদ্ম সুশোভিত। দ্বারকাধীশের বাম দিকে শ্বেত পাথরের রুক্মিণীর মূর্তি। এছাড়াও মথুরানাথ, লক্ষীনারায়ণ ও মুরলী মনোহরের মূর্তি রয়েছে। দোলযাত্রা, ঝুলন ও জন্মাষ্টমীর সময়ে এখানে মহাসমারোহে পালন করা হয়। এছাড়াও বৈশাখ মাসে নৃসিংহদেবের উৎসব এবং শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়ায় দোলায় শ্রী বিগ্রহের দর্শনও উল্লেখযোগ্য উৎসব। মথুরাতে আরো অনেক দর্শনীয় মন্দির ও দ্রষ্টব্য স্থান আছে যেমন - ভূতেশ্বর মহাদেব, কংস কেল্লা ইত্যাদি। এছাড়াও যমুনা তীরের ঘাটগুলিও একান্ত দ্রষ্টব্য স্থান। আজ সারাদিনে আমাদের বিভিন্ন স্থানে যেতে হবে বলে এগুলি আর দেখা হলো না। আমার সফর সঙ্গী সুমিতার সম্মতিতে স্থির হল পুনরায় আমরা বৃন্দাবনে এসে এই সমস্ত স্থানগুলি দর্শন করব। পরবর্তীকালে এই বছরের জন্মাষ্টমীর সময় এসে আমরা ভূতেশ্বর মহাদেবের মন্দিরটি দর্শন করেছিলাম।              
কৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দির থেকে বেরিয়ে সকালের জলযোগ পর্ব শেষ করে আমরা রওনা হলাম গোকুল। কথিত আছে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের কিছুকাল পূর্বে নন্দরাজা প্রথম এখানে জনপদের পত্তন করেন। পরবর্তীকালে নন্দরাজা বিভিন্ন সময়ে কংসের অত্যাচার ও উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে জ্ঞাতিদের নিয়ে গোকুল পরিত্যাগ করে নন্দগাঁও যাবার পরে এই জনপদ গভীর জঙ্গলে পরিণত হয়। তখন থেকেই এই স্থানের পরিচিতি হয় মহাবন নামে। প্রাচীন ব্রজভূমি কালের আবর্তে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে যমুনা তীরে মহাবন থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে গড়ে উঠেছে নতুন গোকুল যার বর্তমান নাম রমনরেতি। তার পূর্বে এই গোকুলে হিন্দু বিদ্বেষী ধর্মান্ধ মুসলমানদের যে আক্রমণের ঢেউ এসেছিল তা আমাদের জানা দরকার। ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে গজনীর সুলতান মাহমুদ মথুরা আক্রমণ করার পরে গোকুল মহাবন আক্রমণ করে গোকুল ধ্বংস করে শতাধিক হাতির পিঠে এখানকার মহামূল্যবান ধনরত্ন বোঝাই করে মথুরার দিকে অগ্রসর হয়। তখন থেকেই গোকুল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। পরবর্তীকালে এই গোকুল মহাবন পুনরায় ধনে জনে পূর্ণ হয়ে ওঠে। এখানে অনেকাংশ জুড়ে ছোট ছোট টিলা। মেবারের রানা কাটিরা এই টিলাগুলির উপরে দুর্গ নির্মাণ করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আলাউদ্দিন খিলজী গোকুল আক্রমণ করেন। কিন্তু গোকুলের সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে সমর্থ না হয়ে ছলনার আশ্রয় গ্রহণ করে রানা কাটিরাকে শ্যামলালা মন্দিরের সামনে হত্যা করে গোকুল অধিকার করেন। গোকুলের অন্যতম এই শ্যামলালা মন্দির। বল্লভাচার্যের সম্প্রদায় মনে করেন এখানে মা যশোদার কন্যা রূপে যোগমায়ার জন্ম হয়েছিল। বর্তমানে এখানে শ্রী উদাসীন কার্ষ্মি আশ্রমের মন্দিরে আছেন রমণবিহারী অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণ। এখান থেকে আমরা গেলাম গোকুলের বিশিষ্ট স্থান বৌদ্ধ-আঙ্গিকে তৈরী চৌরাশী খাম্বা বা চুরাশি স্তম্ভের নন্দভবনে।
                                            পরবর্তী অংশ চতুর্বিংশতি পর্বে…………..


Post a Comment

1 Comments

  1. লেখার প্রবাহ অত্যন্ত প্রাঞ্জল, অনেক দিন আগে এই তীর্থক্ষেত্র ভ্রমনের স্মৃতি আবার নতুন করে জাগরুক হল।

    ReplyDelete