জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়—সপ্তম পর্ব—আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
সপ্তম পর্ব

আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী



‘স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানিনা, তবে যেই আঁকুক, সে ছবিই আঁকে।’- এই রকম কথাগুলিই যেন জীবনস্মৃতিতে পড়েছিলেন বিরজা, বড়ো ভাইপো এনে দিয়েছিলো বইটি কলকাতা থেকে। ততদিনে বাড়ী পাশের শিলাবতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে, তিনিও সব হারিয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে এসে নিঃস্ব জীবনে থিতু হয়ে পড়ছেন ক্রমে, মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। 
মাঝের দু তিন বছরের স্মৃতি কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে পড়তো মাঝেমধ্যে।মনে পড়তো শ্বশুর বাড়ির কথা,কলকাতার কথাও। 
তখনকার দিনে কলকাতা ছিলো পাড়া গাঁয়ের মানুষদের কাছে বিদেশের মতো, আর সেই কলকাতায় নিত্যবাস ছিলো বিরজার, ভাবলেই অবাক লাগে আজও। 
সে যেন স্বপ্নের মতো… 
বস্তুতঃ,বিয়ের পরেপরেই শাশুড়ি ঠাকরুনের সঙ্গে কলকাতা গিয়েছিলো বিরজা;সেখানেই ছিলো শ্বশুরমশাইয়ের বাসা, শ্বাশুড়ীর সংসার। উঁচু পাঁচিলের গায়ে বড়ো বড়ো পামগাছ ঘেরা দুইতলা চূনসুরকীর বাড়ি,শান বাঁধানো মেঝে,সামনে ঢালা বারান্দা, দুই তলাতেই। দরজা সমান জানলাগুলিতে ছিলো খিড়খিড়ি দেওয়া। একটুখানি খিল টানলেই ফাঁক দিয়ে বাইরের সবকিছু দেখতে পাওয়া যেত… নীল আকাশে মেঘের খেয়া, আরও দূরের আকাশে চিলের সঞ্চরণ,বাগানের পরিচিত গাছপালা, চৌবাচ্চার পাড়ের পেয়ারা গাছে ফিঙে আর চড়াইদের কিচিরমিচির…আজন্মের চেনা প্রকৃতিও যেন ভাগ ভাগ করে দেখতে  আলাদা আলাদা  লাগতো।

🍂
দুপুরবেলা সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁকে যেত ফিরিওয়ালা;মাথায় পাগড়ী, গায়ে চাদর। রেশমি চুড়ি, মিশি, আতর, আলতা, রঙিন ফিতে …আরও কতো কি যে তার মাথার ঝাঁকাটিতে থাকতো তার ইয়ত্তা নেই। অধিকাংশ জিনিসই অচেনা ছিলো গাঁয়ের মেয়ের কাছে। একদিন জানলার ফাঁক দিয়ে তা দেখতে দেখতে শ্বাশুড়ীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো নতুন বৌ, 
-’মা! ও কে যায়? ‘
শ্বাশুড়ী ব্যস্ত ছিলেন আসন বুননে। পাড়ের সুতোয় রঙ মিলিয়ে চটের ওপর ফুল-পাতা-লতা ফুটিয়ে তুলতে পারতেন বেশ। খানিক শিখিয়েও ছিলেন বিরজাকে। 
তিনিই ডেকে কিনে দিয়েছিলেন মিশি, রঙিন চুড়ি, ফিতে। রাধুনী বামুনদিদি শিখিয়েছিলেন মিশি দিয়ে দাঁত মাজতে, ফিতে দিয়ে চুল বাঁধতে… 
আরও অবাক ব্যাপার ছিল,একতলায় রান্নাশালা। বিরাট বড়ো দুটি কয়লার উনুনে নানাবিধ রান্না হোত সেখানে,সেই কোন সকাল থেকে। ঠাকুর-চাকর আর ঝিয়েরাই রান্নাবান্না,ঘরকন্না দেখতো, শ্বাশুড়ী সারাদিন সেজেগুজে শুধু তদারকিই করতেন। শহরে নাকি তেমনই রেওয়াজ।
 এমন জীবনে তো অভ্যস্ত ছিলো না ছোট্টো মেয়েটি, সেই প্রথম গাঁয়ের মেয়ের কলকাতা দেখা; হাওড়ার ব্রীজ, রাস্তায় রাস্তায় গ্যাসের আলো, প্রতিদিন সকালে পাইপ দিয়ে রাস্তা ধোওয়া, ঘরের মধ্যেই স্নানের ব্যবস্থা,কল খুললেই জল পড়া, সে জল সারাদিন ধরে রেখে ব্যবহার করা, মানুষ সমান উঁচু চৌবাচ্চা, নদীমাটির বদলে সাবান ঘসে ঘসে নকল ফেনায় স্নান; কাঠের বদলে কয়লার গনগনে আগুনে রান্না… এমন সব আজব ঘটনা সে জন্মেও দেখেনি, তখনও পর্যন্ত। 

তবে,কলকাতার জীবনে বিরজার আরও এক আশ্চর্য আবিস্কার ছিলো সেমিজ। তখনকার দিনে দেশে ঘরে মেয়েদের সেমিজ পরার চল ছিলোনা। বিরজার সমবয়সী সইদের কারো তা ছিলোও না। কলকাতায় নিয়ে গিয়ে শ্বাশুড়ীমা মুসলমান দর্জি ডেকে মাপ নিয়ে তাকে সেমিজ বানিয়ে দিয়েছিলেন। বিরজা যখন বাবার ঘরে ফিরে সেসব দেখাতো, সবার চকচকে চোখ দেখে খুব আনন্দ হোত তার।
 হায় ভগবান! কে জানতো, সে সৌভাগ্যের অহঙ্কার এতোখানি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছিলো! 
যাহোক, তখন তো এতোসব বোঝার ক্ষমতা ছিলো না,শুধু মনে পড়ে, পায়ে ভারী মল, হাত ভরা চুড়ি-কঙ্কন, গায়ে নতুন নতুন শাড়ি-সেমিজ পরে, ছোট্টো মেয়েটি মজা পেত খুব। 
এমনিতে শ্বাশুড়ী মানুষটি মন্দ ছিলেন না, শ্বশুরমশাই কাজে বেরিয়ে গেলেই বিরাজ সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াতো, গায়ের কাপড় এলোমেলো হয়ে যেত; শ্বাশুড়ী কিছু বলতেন না। বরং নীচের টানা বারান্দায় পাখীর খাঁচায় দানাপানি দিতে যাওয়ার বায়না করে বুড়িবামনি রাঁধুনি ঠাকরুণের বকুনির হাত থেকে তিনিই বাঁচাতেন তাকে। আবার,বিকেল বেলা কাছে ডেকে নিজের আঁচলে মুখ মুখিয়ে সিঁদুর পরিয়ে দিতেন। চুলে চুপচুপে করে তেল মাখিয়ে বেড়াবিনুনি গেঁথে সেই চুল বেঁধে দিতেন। কি সুগন্ধি সেই তেল! কি সুন্দর তার নাম! জবা কুসুম, জবা কুসুম!... নামের মতোই তেলটির রঙও ছিলো টকটকে লাল। 
     রাতে ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করতো, বুক ভরে গন্ধ মাখতো গাঁয়ের মেয়ে… 
পাশে শোওয়া শ্বাশুড়ীর ঘুম ভেঙে যেত, হাতের চাপড়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিতে চাইতেন মা-মরা মেয়েটিকে। মেয়েটি কিন্তু ঘুমচোখে তাকিয়ে থাকতো পাশের ঘরের দিকে। সে ঘরে তখনও সেজের বাতি জ্বলে, পড়াশোনা… 
সে ঘরে থাকতো শ্বাশুড়ীর ছেলে। কেমন যেন খঠোমটো স্বভাব তার। দাদাদের মতো হাসিখুশি নয়। বিরজা যতবার ভাব করতে গিয়েছে, ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে, তারপরে তো মরেই গেল, দেখাই হলো না। তাই ভাবই হয়নি তার সঙ্গে জীবনভর… 
আজও যখন সে বাড়িটির কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে সবার আগে তাই মায়েরই কথা। কখনো কখনো শ্বশুর মশাইয়ের গলা, বুড়ি বামনীর বকুনি বা দারোয়ান চাচার হাসিমুখও। কিন্তু যে মা নিজের ছেলের মতো আদর দিয়ে তাকে মানুষ করতে চেয়েছিলেন, তাঁকে শ্বাশুড়ী নয়, মা বলেই ডাকতে ইচ্ছে হোত, জ্যাঠাইমার চেয়ে শ্বাশুড়ীকে কম ভালো বাসেনি তাই বিরজা। 
এই যে, ভাইপো-বৌদের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা, আগলে রাখার ইচ্ছে, এর মধ্যে কখনো কখনো যে সেই মায়ের ছায়াই এসে দাঁড়িয়ে থাকে, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বেশ টের পান তিনি। 
বিশেষত ফুল-পল্লবহীন তাঁর এই মরুজীবনে শ্বাশুড়ী ছিলেন পুকুরভরা জল; এমনকি, বিধবা হওয়ার পরেও। কিন্তু যে মেয়ে জন্মেই নিজের গর্ভধারিনী মাকে খায়, তার কপালে সামান্যতম স্বস্তিও যে লেখা নেই, তা বোধহয় বিরজা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন। 

সত্যিই, আজও ভাবলে জীবনভর সেসব কথা স্বপ্নই মনে হয়। কবে যে বড়ো হলেন,বিয়ে হলো,সংসার শুরুর আগেই কবে সব হারিয়ে আবার বাবার বাড়িতে ফিরে এলেন, কিভাবে সারা জীবনটা কাটিয়ে দিলেন এমন সব না-ধরা-না-ছোঁয়া  অনর্থক ব্যস্ততায়, তা আজ আর মনেও পড়েনা। 
শুধু আজকাল যখনই একা থাকেন, কার যেন না বলা কথা;একগাদা বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকা কাউকে যেন দেখতে পান। হয়তো বইয়ের প্রতি এই যে তাঁর জীবনভর আকর্ষণ, তার কারণও সেই মানুষটিই;যাকে তিনি এ জীবনে চিনলেনই না! 
যাইহোক, প্রকৃতির ধর্মই তো এগিয়ে চলা; দুঃখ-সুখ সব পেরিয়েই… 
তিনিও ভেসে ভেসে এগিয়েছেন। রোগ শয্যায় শুয়ে শুয়ে সেই যাত্রাপথের বহুবর্ণ অভিজ্ঞতাই রোগিনীর সম্বল।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments