জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-১০৫/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব  ১০৫

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 স্বামীজী ও গঙ্গাধর মহারাজ
----------------------------------------
 স্বামীজীর অতি প্রিয় গুরুভাই ছিলেন গঙ্গাধর মহারাজ অর্থাৎ স্বামী অখণ্ডানন্দজী। বস্তুতপক্ষে রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের সেবা কার্য তাঁর হাত ধরেই শুরু হয় মুর্শিদাবাদের সারগাছিতে। এই সারগাছি সংঘের প্রথম সেবা কেন্দ্র। অখণ্ডানন্দজী স্বামীজি সম্পর্কে নানা সময়ে নানা কথা বলেছেন। তার কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে দিলে মন্দ হয় না, কারণ সেগুলি চমৎকার ও আকর্ষণীয়। সরসীলাল সরকার রচিত 'অখন্ডানন্দজীর স্মৃতি’ ( উদ্বোধন কার্যালয়) থেকে কিছু অংশ তুলে দেওয়া হল। তিনি লিখছেন --“অখণ্ডানন্দজী বলতেন, ‘স্বামীজীর কথা কী বলব তার কাছে আমি এতটুকু।’ রাজনারায়ণ বসু মহাশয়ের কাছে স্বামীজীর সঙ্গে তিনি একদিন গিয়েছিলেন। স্বামীজি তার আগেও রাজনারায়ণ বসুর কাছে গিয়েছিলেন। পরমহংসদেবের শিষ্য বলে স্বামীজীকে বসু মহাশয় জানতেন। মহারাজ বলেন, ‘যখন রাজনারায়ণ বসুর কাছে যাচ্ছি স্বামীজী আমায় বললেন দেখিস কথাবার্তার ভিতর ইংরেজি বকুনি যেন দিসনি।’ স্বামীজী যে ইংরেজি জানতেন, তা বসু মহাশয়ের ধারণা ছিল না। আমরা গিয়ে বসু মহাশয়ের কাছে বসলাম। বসু মহাশয় স্বামীজীর ভ্রমণ বৃত্তান্ত শুনছেন, কিছু কিছু নোটও করে নিচ্ছেন। কথাপ্রসঙ্গে ‘plus’ কথাটি রাজনারায়ণ বসু বলে ফেলে বাংলায় বুঝাচ্ছেন আঙুল দিয়ে, ‘+’ চিহ্ন এঁকে বোঝালেন। আমি তখন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি; বলেই ফেলি, এরকম অবস্থা আমার। স্বামীজী তখন চোখ টিপছেন। কথাবার্তা শেষ করে, চলে এলাম। রাজনারায়ণ বাবু ধরতেই পারলেন না যে স্বামীজী ইংরেজি জানেন।
🍂
 ‘আরেকবার স্বামীজীর সঙ্গে গিয়েছি এক অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর ঘরে একটি খাটিয়ার বিছানা, তাতে নিজেই বসে আছেন -- একটি স্টোভ জ্বলছে, তাতে রান্না হচ্ছে। তিনি একবার খাটিয়ায় বসছেন, একবার উঠে রান্নায় খুন্তি দিচ্ছেন। মেঝেয় একটি শতরঞ্চি পাতা, আমি ও স্বামীজী বসে আছি। স্বামীজি তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। আমি বিষম বিরক্ত হচ্ছি, স্বামীজীকে নিচে বসতে দিয়েছেন আর নিজে উঁচুতে বসে আছেন। ফিরে আসার সময় স্বামীজি আমায় বললেন, ‘ওরে, ও কি আমায় অসম্মান করেছে? কী জানিস ওরা কোনো formality-র ধার ধারে না -- খাঁটি লোক -- আমাকে নমস্কার না করলে কি হলো, আমায় যথেষ্ট সম্মান করে।’
 কথা প্রসঙ্গে অখণ্ডানন্দজী একজনকে বললেন, ‘তুমি বাইরে যাচ্ছ, একে ( আশ্রমের একটি অনাথ বালক ) সঙ্গে নিয়ে যাও। কাল ও তোমার সঙ্গে গিয়েছিল।’ সেই ব্যক্তি বললেন, কাল ও আমার সঙ্গে যায়নি। Short cut করে গিয়েছিল।’ মহারাজ বললেন, এটি ছোঁড়াদের দুর্বুদ্ধি?  তুমি নতুন মানুষ তাই তোমায় দেখিয়ে দিলে। তবে শোন, পরিব্রাজক অবস্থায় স্বামীজীর সঙ্গে বেড়াচ্ছি -- আমি ছেলেমানুষ। এক জায়গায় স্বামীজী গেলেন বনের পথ দিয়ে, আমাকে বললেন -- একটু ঘুরে আসতে; কিছু দূরে গিয়ে স্বামীজীর সঙ্গে দেখা, দেখি স্বামীজী একা -- কিন্তু হাসছেন, কার সঙ্গে যেন কথা কইছিলেন, চোখেমুখে কী এক আনন্দের ভাব! জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই কার সঙ্গে কথা কইছিলে?’ তিনি চুপ করে শুধু মুখ টিপে হাসতে লাগলেন।
 অখণ্ডানন্দজী বলেন, ‘দেখ, এমন দিনও গিয়েছে, ক্লাস করতে করতে রাত ২টা বেজে গিয়েছে। স্বামীজী বিছানায় শোননি।  চেয়ারে বসেই বাকি রাতটা কাটিয়েছেন। অথচ আমাদের সকলের আগে উঠে, প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে গঙ্গার ধারে পূর্ব দিকের বারান্দায় বেড়াচ্ছেন।‌ আমি চিরকালই ভোরে উঠি -- অতি ভোরে। আমি উঠেই দেখি, তিনি ঐরকম বেড়াচ্ছেন।
 ‘স্বামীজীর গর্ভধারিণীর মুখেও শুনেছি বাল্যকালে কিংবা বড় হয়েও ( শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে যাওয়ার আগেও ) কখনো বেলা অবধি ঘুমাননি। কখনো না -- অতি ভোরে উঠতেন। মঠে স্বামীজী আমাদের সকলকে ভোরে উঠে ঠাকুরঘরে গিয়ে ধ্যান করবার নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন -- নিজেও আমাদের সঙ্গে গিয়ে ধ্যান করতেন। স্বামী ত্রিগুণাতীতের চার দিন জ্বর -- জল-সাগু খেয়ে আছেন। স্বামীজী ধ্যান করতে ঠাকুর ঘরে যাওয়ার সময় তাঁকেও ডাকলেন, ‘ওরে আয়। জ্বর -- তার আর কী?  ধ্যান করবি চল -- তোরা যদি জ্বর হয়েছে বলে ধ্যান না করিস -- লোকে তো তোদের দেখে শিখবে!’ এই বলে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে ঠাকুর ঘরে গেলেন।
 স্বামীজী বলতেন, চাকরি কোরো না। চাকরি শ্ব-বৃত্তি -- কুকুরের কাজ। চাকরি আপদ ধর্ম -- আপদকালে কেবল চাকরি করা যায়। ফকিরিও ভালো, তবু চাকরি করা উচিত নয়।“
 সিস্টার নিবেদিতার বিষয়ে অখণ্ডানন্দজী  আলোকপাত করছেন এইরকম -- “স্বামীজী যেদিন শ্রীশ্রীমায়ের কাছে  সিস্টার নিবেদিতাকে নিয়ে যান, স্বামী অখণ্ডানন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নিবেদিতাকে শ্রীশ্রীমায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে স্বামীজী বলেছিলেন, ‘মা, আকাশের একটি ফুল এনেছি। পৃথিবীর ধূলিকণা, মলিনতা কিছুই যেন একে স্পর্শ করেনি।’ নিবেদিতা যেদিন জাহাজ থেকে ভারতে নেমেছিলেন, সেদিন তাঁর কাছে মাত্র দুটি টাকা ছিল। ওপারের কোনো সম্বলই যেন তিনি এপারে আনেননি। নিবেদিতা যখন ভারতে আসেন, একজন সাহেব তাঁর রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে যায় -- তাঁকে বিবাহ করবার জন্য পাগল হয় --  সেই সাহেব এমনকী মঠ অবধি ধাওয়া করে। তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য নিবেদিতা চটপট vow নেন। স্বামীজীও তাকে ব্রহ্মচর্য দেন -- ‘নিবেদিতা’  ইত্যাদি সব হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। 
 নিবেদিতা কলকাতায় এসে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে খুব মিশতেন। তাতে স্বামীজীকে political missionary বলে অনেকে ঠাওড়ায়। একদিন স্বামীজী নিবেদিতাকে সতর্ক করে দেন --  নিবেদিতা কাঁদো কাঁদো হয়েছিলেন। তারপর নিবেদিতা খবরের কাগজে series of articles লেখেন।“

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments