কবি জয় গোস্বামী-র সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মৌসুমী ঘোষ
“নিজের কবিতা আমি ফিরে পড়ি না, আমি সে সময় অন্য কারো বই দু’বার তিনবার চারবার করে পড়ি।” – কবি জয় গোস্বামী।
মৌসুমী : কোভিড পরিস্থিতি ও তার পরবর্তী সময়ে, আপনার লেখা কবিতাগুলো বা লেখাগুলো নিয়ে কিছু যদি বলেন…
কবি: প্রথম কথা হচ্ছে, এইবার পুজোর সময় আমার যত কবিতা ছাপা হয়েছে, এমনকি যে উপন্যাসটি ছাপা হয়েছে, সবই আমার কোভিডে আক্রান্ত হবার আগে লেখা। কোভিডের পরে আমি কিছু লিখিনি, এমনকি কোনো কবিতাও লিখিনি। আমি তো মে মাসে কোভিডে আক্রান্ত হই, তার আগে যা লেখা ছিল সেইগুলো আমার জমানো ছিল বলে আমার কাছ থেকে যখন বিভিন্ন পুজো-সংখ্যা থেকে লেখা চাওয়া হল, সেগুলো দিয়ে দিতে পেরে ছিলাম। এই…
মৌসুমী: নিউ নর্মাল সিচুয়েশানে শিশুদের দৈনন্দিন জীবন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের হাতে এখন মোবাইল, অডিও-বুক। তাদের জন্য এখন লিখতে গেলে দাদাভাইদের পাড়া, শুভ জন্মদিন, ছেলেবেলা নামক শহরে, অভিনয়ে এলেন, মাথা ঘোরা মাস্টার, ফুটকড়াই-এ যেসব চরিত্ররা যেমন পরি আর পরির বোন, ছোট্ট বিনি, সুবীরবাবু, বাবুকান্তি, মাথা-ঘোরা-মাস্টার এদের কি নতুন ভাবে আনবেন?
কবি: আমি আগের থেকে লেখার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা করতে পারি না।
মৌসুমী: কোভিড পরিস্থিতিতে কবিরা সকলেই ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে অণু কবিতা, অণুগল্প বা মুক্তগদ্য লিখেছে অকাতরে। এতে কি সাহিত্যের ক্ষতি করছে তারা?
কবি : আমি নিজে ফেসবুকে নেই, তবে আমাদের সময় আমার বয়স যখন ঊনিশ কুড়ি একুশ বাইশ তেইশ চব্বিশ পঁচিশ — এরকম সময় বা আরো পরে আমার সামনে ছিল লিটিল ম্যাগাজিন। আমি লিটিল ম্যাগাজিনে কবিতা পাঠাতাম আর ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা পাঠাতাম। সেখানে কিছু লেখা ছাপা হতো। তা আমার ঐ বয়সে যদি ফেসবুক থাকতো তাহলে আমি যে ফেসবুকে কবিতা দিতাম না — এ কথাতো আমি জোর করে বলতে পারি না। কী করে বলব? যখন যে মাধ্যম প্রধান হয়ে ওঠে। তখন লিটিল ম্যাগাজিন ছিল প্রধান মাধ্যম আর ‘দেশ’ ছিল। তাই লিটিল ম্যাগাজিন আর ‘দেশ’এ কবিতা পাঠাতাম। এখন ‘ফেসবুক’ এসেছে। তাই এখনকার তরুণরা ‘ফেসবুক’ ব্যবহার করছেন। লেখাগুলো যখন বই হয়ে বেরোবে তখন সেগুলো পড়ে তার বিচার করা যাবে। এর দ্বারা কবিতার বা সাহিত্যের ক্ষতি হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।
মৌসুমী: কোভিড পরিস্থিতিতে আমাদের সকলেরই প্রিয়জন বিয়োগ হয়েছে। আপনার কাছে সেই ধাক্কাগুলোর প্রভাব নিয়ে যদি বলেন, বিশেষত কবি শঙ্খ ঘোষের চলে যাওয়ার বিষয়টি…
কবি: ( কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর ) নিশ্চয়ই বাংলা সাহিত্যে একটা বড়ো শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। গত দেড় বছরে আমাদের মাথার ওপর যারা অভিভাবক স্বরূপ ছিলেন তাঁরা সকলেই চলে গেছেন। অনেকেই চলে গেছেন। সনৎ কুমার মুখোপাধ্যায় শেষ কয়েকদিন আগে চলে গেলেন। দেবেশ রায় চলে গেছেন। অরুণ সেন চলে গেছেন। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তারপর চলে গেছেন। সুধীর চক্রবর্তী চলে গেছেন। চলে গেছেন অলোক রঞ্জন দাশগুপ্ত। তারপর শঙ্খ ঘোষের বিদায়ে যেটা হল সেটা একটা মহাশূণ্যতার সৃষ্টি হল। এবং সেই শূণ্যতা যেমন সাহিত্য ক্ষেত্রে তেমন আমার ব্যক্তিগত জীবনেও। আমি সেই শূণ্যতার মধ্যেই এখনও নিমজ্জিত রয়েছি। আর এর তো কোনো পরিপূরক কিছু হবেনা, শঙ্খ ঘোষের তো কোনো বিকল্প হয় না।
মৌসুমী: যখন আমাদের পরিবারগুলো কোভিডের সঙ্গে যুদ্ধ করছি তখন সাহিত্যপ্রেমী অনেকেই কবিতার কাছে আশ্রয় নিচ্ছে, নিজে না লিখতে পারলেও প্রিয় কবিদের লেখা পড়তে চাইছে। আপনি সেই পাঠককে আপনার লেখা কোনো কবিতার বই বা উপন্যাস তুলে দিতে চাইবেন শ্রুশ্রূষার জন্য?
কবি: আমার মনে হয়না আমি এমন কোনো বই, এমন কোনো কবিতা এখনও পর্যন্ত লিখতে পেরেছি যা অন্য ব্যক্তিকে শোকে শুশ্রূষা বা তাকে একটা সান্ত্বনা দিতে পারে, তাকে একটা আনন্দ দিতে পারে, এরকম মনে হয় না আমার।
মৌসুমী : ‘ডাকঘর’ তো আপনার প্রিয় লেখা, ‘ডাকঘর’এর অমলের অসুস্থতা নাকি একাকিত্ব — কোনটার জন্য আপনার বেশি কষ্ট হয়? আপনি যদি কোভিড পরবর্তী সময়ে আবার ‘ডাকঘর’ লেখেন, অমলকে বাঁচিয়ে দেবেন?
কবি : প্রথম যখন ডাকঘর পড়েছিলাম, তখন অমলের বিদায়-এ কষ্ট পেয়েছিলাম ঠিককথা। এখন বুঝি যে, ঐ বিদায়ের মধ্যে একটা সৌন্দর্য রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমাকে সবচেয়ে বেশি যেটা আকর্ষণ করে সেটা হচ্ছে অমলের যে অপূর্ব কল্পনা-শক্তি। ঐ ছোট্ট ঘরের জানলায় বসে বসে দূর দূর গ্রাম দেখতে পেত, সেখানে বৌ-রা জল নিতে যাচ্ছে দেখতে পেত, লাল সুরকির পথ দেখতে পেত, সে একজন পথিক কে দেখতে পেত, সে কেবলই আসছে, পার হয়ে হয়ে আসছে… যেন সে পথ পার হয়ে কেবলই আসছে, দইওয়ালার গ্রাম দেখতে পেত। মানে যে অপূর্ব কল্পনা-শক্তি, যাকে জীবনানন্দ বললেন পরবর্তীকালে, জীবনানন্দ অমল সম্পর্কে বলবেন না, কবির সম্পর্কে বলবেন। তিনি বলবেন যে ‘কল্পনা-প্রতিভা’, এই শব্দটি বলবেন জীবনানন্দ পরবর্তীকালে। রবীন্দ্রনাথ তো সেই কল্পনা-প্রতিভার পরিচয় আমাদের বাংলা সাহিত্যে একেবারে প্রথমেই দিয়ে গেছেন। এই অমলের মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি যেটা আকর্ষণ করে সেটা হচ্ছে এই দেখতে পাওয়া, সুদূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়ার যে দৃষ্টি এবং তার যে অপূর্ব কল্পনা প্রতিভা এইটে আমায় সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে। তাই তার মৃত্যুর কথা আর মনে থাকে না।
আমি ডাকঘর লেখার কোনো চেষ্টাই করব না কারণ এটা এত মহৎ একটি সাহিত্য যে আমার ধারণা আমার একটা নিজের সীমাবদ্ধতা কতটুকু সে সম্বন্ধে তো আমার একটা সাধারণ চেতনা আছে। তাই আমি কখনোই, এটা নিজের যাকে বলে সেলফ এস্টিম। সেদিক দিয়ে আমি বুঝতে পারি যে ডাকঘরের মতো কোনো লেখার চেষ্টাই আমি করতে পারব না।
মৌসুমী: ২০২২ সালটি কবি রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরীর জন্ম শতবর্ষ। ওনার কবিতা যখন প্রথম পাঠ করলেন সেই অনুভূতি শুনতে চাই। এই সময়ে এসে যখন আবার পড়েন তখন আপনার অনুভূতি কি বদলে গেছে মনে হয়?
কবি : ধ্রুপদ গাইয়েরা, ধ্রুপদ গান এখন বিলুপ্তপ্রায়। কয়েকজন ধ্রুপদ গাইয়ে আছেন নিশ্চয়ই বা রুদ্রবীণা বাদক আছেন, যাঁরা ধ্রুপদ অঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। কিন্তু ধ্রুপদের শ্রোতা খুব কম। সেই গান আদি গান। এবং সেই গানের শ্রোতা খুব কম। কিন্তু যে ক’জন শ্রোতা আছেন তাঁরা কখনোই ধ্রুপদ গান শোনবার যে আনন্দ তাকে ত্যাগ করেন না। তাঁরা বারবারই শোনেন। অল্প শ্রোতা কিন্তু সেই শ্রোতা দীক্ষিত এবং তাঁরা মর্মগ্রাহী শ্রোতা। রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরীর কবিতাও সেইরকম সেই ধ্রুপদ গানের মতোই, পড়বেন অল্প লোক, কিন্তু যারা পড়বেন তাঁরা বার বার পড়বেন এবং পড়ে তাঁরা তার মধ্যে থেকে নতুন নতুন মণি-মাণিক্য আবিষ্কার করবেন।
মৌসুমী : দীর্ঘ কবিতা জীবন পার করে এসে কোনো বিশেষ কবিতার সৃষ্টি মুহূর্তের কাছে কি ফিরে যেতে ইচ্ছে করে আপনার?
কবি : যেটা একবার লিখেছি সেটা আবার লিখব কেন?
মৌসুমী: কবিতা আর গদ্য উভয় মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যাবার পর এদের বিভেদ রেখাটি আপনার কাছে আজ কীভাবে ধরা পরে?
কবি: মানুষের, আমি অন্তত আমার জীবনে দেখেছি যে, কিছু অভিজ্ঞতা এবং অনুভব আছে যা কবিতার মাধ্যমে প্রকাশিত হতে চায়। প্রকাশের জন্য উন্মুখ হয়। আবার কিছু কিছু অভিজ্ঞতা ও অনুভব আছে যা দাবী করে গদ্যের আকার। যেমন, আমি কবিতা সম্পর্কে যেসব গদ্য লিখেছি যেমন আমার ‘রৌদ্র ছায়ার সংকলন’ বলে একটি বই আছে, ১৯৯৪ সালে আমি প্রথম কবিতা সম্পর্কে লিখতে শুরু করি তখন আমার বয়স চল্লিশ। তার আগে আমি কবিতা সম্পর্কে কিছু লিখি নি। তারপর থেকে আজ ২০২১ পর্যন্ত একটানা আমি কবিতা সম্পর্কে গদ্য লিখে এসেছি। যেমন তিনখন্ড ‘গোঁসাই বাগান’ বলে বই লিখেছি, ‘কবির মৃত্যু ও অন্যান্য গদ্য’ বলে একটি বই লিখেছি। তাতে অনেক বাঙালি কবিদের সম্পর্কে আলোচনা আছে। ‘আকস্মিকের খেলা’ বলে আমার একটি বই আছে, সেখানেও আমি অনেক কবিদের নিয়ে আলোচনা করেছি। এই যে কবিতা পড়ার পরে মনের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে — সেই কবিতায় একটা শব্দ ব্যবহার, একটা ছবির ব্যবহার, চিত্রকল্পের ব্যবহার, একটা স্পেসের ব্যবহার অথবা একটা কমার ব্যবহার, একটা ড্যাশের ব্যবহার কীভাবে আসছে, সেইটা কবিতার মধ্যে দিয়ে অন্য কোনো কবিতা লিখে প্রকাশ করা যায় না। সেইটা প্রকাশ করতে হলে গদ্যের আকার দরকার হয়। সুতরাং আমি আমার জীবনের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা, যেমন — আমার জীবনে শোক এসেছে, আমার জীবনে অপমান এসেছে, আমার জীবনে আনন্দ এসেছে, আমার জীবনে প্রেম এসেছে, আমার জীবনে সম্মান এসেছে, এই সমস্ত অভিজ্ঞতাই যখন আমার অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞতা থেকেই কবিতা এবং গদ্য যে কোন জিনিস সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনি আমার জীবনে অজস্র কবিতা পড়াটাও একটা অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে মিশে আছে আমার মনে। সুতরাং আমি যখন কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতাটাও আমার লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চাইলাম তখন আমাকে আশ্রয় নিতে হল গদ্যের আকারে। সুতরাং মূল কথা হল এই যেটা প্রথমে বললাম যে, কিছু অভিজ্ঞতার অনুভব আছে যা কবিতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেতে চায়, পেতে উদগ্রীব হয়। আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে, কিছু অনুভব আছে, যা গদ্যের গঠন দাবী করে। তখন সেটা গদ্যের আকারে নিজের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে।
মৌসুমী: কোনো নারীর সঙ্গে পরিচয়, তাকে ভালোলাগা, তাকে নিয়ে উপন্যাস বা কবিতা লেখা, তারপর আবার সেই নারী হারিয়ে যাওয়া। এটাকে কি আপনি প্রেম বলবেন?
কবি : জীবনের অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে যেমন আমি আমার মাকে পেয়েছিলাম এবং একটা সময় আমি আমার মাকে হারিয়েও ফেলি। আমার মা মারা যান, তখন আমি ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ বলে একটা বই লিখেছিলাম — আমার মায়ের মৃত্যুর পর। তারপরে আমি ‘ভুতুম ভগবান’ বলেও একটি বই লিখেছিলাম। পরে অন্য সময়েও আমার মা আমার লেখার মধ্যে ফিরে এসেছেন, মায়ের কথা আমার লেখার মধ্যে ফিরে এসেছে। তা গদ্য রচনার মধ্যেও এসেছে, কবিতা রচনার মধ্যেও এসেছে। এবার আমার বক্তব্য হচ্ছে যে, তেমনি যদি কোনো বন্ধুত্ব, কোনো শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক, কোন নারীর সঙ্গেও সম্পর্ক – এই সমস্ত সম্পর্ক আসে এবং চলে যায়। অর্থাৎ দূরে চলে যায়। কখনো তা মৃত্যুর দ্বারা হতে পারে, কখনো তা স্থানিক দূরত্বের দ্বারা হতে পারে, কখনো তা মতভেদের দ্বারা হতে পারে। দূরত্ব হয়ে যাওয়া মানে কিন্তু সেটা চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়া নয়। তার একটা রেশ প্রথমে অভিজ্ঞতার মধ্যে সঞ্চিত থাকে এবং পরে কখনো কখনো অপরোক্ষ ভাবে কখনো বা পরোক্ষ ভাবে এটার প্রকাশ ঘটতে থাকে। ফলে প্রত্যক্ষ একটি নাম দিয়ে এই ধরনের সম্পর্ককে আমি ঠিক চিহ্নিত করতে পারি না। একটা জিনিষের সঙ্গে আর একটা জিনিষ মিশে যায়। একটা অভিজ্ঞতার সঙ্গে আর একটা অভিজ্ঞতার মিশ্রণ হয়ে যায়।
মৌসুমী: ‘সব অন্ধকার ফুলগাছ’ উপন্যাসটিতে নায়ক সোমনাথ এক স্বপ্নসুরলোকের সন্ধান করে গেল অথচ নামটি হল ‘সব অন্ধকার ফুলগাছ’। এই নামটি রাখার পিছনের গল্পটি যদি বলেন…
কবি : সোমনাথ কি তার সঙ্গীতের স্বীকৃতি পেয়েছিল? পায়নি তো? কিন্তু সে কি সঙ্গীতকে ত্যাগ করেছিল? দ্বিতীয় কথা হল যে, ঐ একটি মেয়ে তার বাড়ির এক তলায় ভাড়া থাকত, তারা একদিন ঐ বাড়িটার ভাড়া ছেড়ে চলে যায়। তখন সোমনাথ সেখানে গিয়ে দেখে যে, একটা ক্যালেন্ডার শুধু তারা ফেলে গেছে যেটা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। তখন তার মনে আবার অতুল প্রসাদ সেনের গানের কয়েকটা লাইন ভেসে আসতে থাকে। ‘জল বলে চল মোর সাথে চল এ আঁখি জল হবেনা বিফল’। আমি বলতে চাইছি সোমনাথের যে গানের আনন্দ আর গান নিয়েই সে বেঁচে আছে। কিন্তু সে খুব সাধারণ জীবন যাপন করে। একটা কলেজের সে ক্লার্ক মাত্র। এবং তার দাম্পত্য জীবনও সুখের নয়। তাই তো? এবং কলেজের সেই অধ্যাপিকার সঙ্গে সে একজন প্রখ্যাত দ্বিজেন্দ্রগীতি গায়িকার মিল পায়। সেখানে দ্বিজেন্দ্রলাল তারপর অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত (একটাই মাত্র রবীন্দ্রনাথের গান আছে ওখানে) দিলীপকুমার রায় এঁদের কথা আছে। এই সমস্ত গানের সেই সময়ের একজন খ্যাতিময়ী মহিলা শিল্পীর, সোমনাথ খুব ভক্ত এবং নিজের বাবার কাছে আর নিজের স্কুলের মাস্টারের কাছে গান শুনে শুনে সে সেই সমস্ত গান গাইবার চেষ্টা করত। আর সেই গান সে গায় নিজের জন্য। তাকে একবার কলেজে জোর করে সবাই গানের জন্য স্টেজে তুলে দিয়েছিল এবং সে গান গেয়েছিল বটে কিন্তু সে তো গানকে — ( উপন্যাসের প্রথম লাইনটাই হচ্ছে ‘ সঙ্গীত কল্পনা করে সোমনাথ’), সঙ্গীত তো তার কাছে কল্পনার ব্যাপার। গান গাইবার অধিকারী সে নয়। আমাদের মনে পড়বে সোমনাথের বাবাও একথা বলতেন ‘আমি গান গাইবার অধিকারী নই।’ এমনকি প্রধান শিক্ষকও বলতেন, ‘আমি গান গাইবার অধিকারী নই।’ মানে এই যে আত্ম সন্দেহ এবং গানকে নিয়ে বাঁচা অথচ গানের জন্য কোনো স্বীকৃতি না পাওয়া, এটাই হচ্ছে অন্ধকার। আর ফুল গাছ (!) – সারাক্ষণ গানে ভরে আছে যার মন সে তো ফুল গাছের মতোই। এরকম মানুষ কি সোমনাথ একা? আরো অনেক মানুষ কি এরকম নেই? সুতরাং সমস্ত অন্ধকার ফুলগাছরাই হচ্ছে সোমনাথ।
মৌসুমী: আপনার লেখা আমার সবচেয়ে পছন্দের উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’ একটি। বাবার সঙ্গে মেয়ের কথোপকথন, বিশেষত বাবার কাছে মেয়ের জিজ্ঞাস্য, মেয়েটির এই যে আলোর দিকে যাত্রা, প্রথম পুরুষ হিসেবে বাবাকে চেনা, আপনি একজন পুরুষ হিসেবে কী করে লিখলেন? যেহেতু আপনি বার বার বলেছেন, উপন্যাস আপনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছেন তাই এই জিজ্ঞাস্যটি উত্থাপন করলাম।
কবি : নিশ্চয়ই, আমার সমস্ত লেখাই অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। মেয়েও তো একজন মানুষ তাই না? মেয়ে মানেই কি শুধুই মেয়ে? যেহেতু সে একজন মানুষ তাই মানুষের ভিতরে যে সমস্ত অভিজ্ঞতা তার সন্ধান তো আমার জীবন যাপনের মধ্যে আমি করে থাকি, করে চলেছি। সুতরাং নারীও মানুষ, পুরুষও মানুষ। সুতরাং নারী ও পুরুষ দুইয়েরই মনোধর্মকে অনুসন্ধান আমি চালিয়েছি। তারফলে আমি লিখেছি, এছাড়াও একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও হয়েছে নিশ্চয়ই। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া তো অনুসন্ধান চালানো যায় না। এইভাবেই তৈরি হয়ে গেছে এই চরিত্র, এটা যে আমি খুব জেনে শুনে তৈরি করেছি তা নয়। প্ল্যান করে তৈরি করা নয়।
আমার সাক্ষাৎকারের একটি বই আছে ‘নির্বাচিত সাক্ষাৎকার’ বলে — তাতে এই বিষয়ে আমি বলেছি।
মৌসুমী : প্রথম কবিতার যে বইগুলো প্রকাশ পায়, তার যে প্রচ্ছদ হয়, পরে সেই প্রচ্ছ্ সংকলন করলে আর থাকে না। অলংকরণও থাকে না। একটি বই মানেই কবিতা বা গল্প, তার অলংকরণ, তার প্রচ্ছদ সব মিলে। আপনার নিজের ক্ষেত্রে এমন কোনো প্রথমদিকের বই আছে কি যার কবিতাগুলো প্রচ্ছদ বা অলংকরণ ছাড়া আপনার অসম্পূর্ণ মনে হয়?
কবি : আমি বই-এর ভিতরের লিখিত শব্দ নিয়ে চিন্তা করি। তার প্রচ্ছদ বা অলংকরণ নিয়ে চিন্তা কখনো করিনি। ওগুলো প্রকাশকদের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। প্রকাশকরা যেমন বোঝেন, তেমন করেন। যেমন ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ এই বইটি যখন প্রথম বেরোয় তখন এই বইটির ভিতরে কোনো অলংকরণ ছিল না। বইটি ছিল আশি পাতার বই। মানে পাঁচ ফর্মার বই। তারপর তার ছয় বছর পর এই বইটি অ্যাকাডেমি পুরস্কার পায়। তারপর এই বই-এর যিনি প্রকাশক তিনি স্থির করেন, এই বইটিকে তারা শোভন সংস্করণে বার করবেন। তখন বইটি দেখতে মোটা হয়। তখন তার ভিতরে অলংকরণ করেন সুব্রত চৌধুরি, যিনি খুবই নামকরা অলংকরণ শিল্পী। এবং সে বইটি আবার বেরোয়। আমার শুধু দেখার দরকার বই-এর শব্দগুলোর কিছু এদিক ওদিক হল কিনা। এদিক ওদিক না হলেই ঠিক আছে। আমি প্রচ্ছদ বা অলংকরণ নিয়ে কখনো মাথা ঘামাই নি। কারণ আমি তো চিত্রশিল্পী নই।
মৌসুমী :‘যেখানে বিচ্ছেদ’ কাব্যনাট্যটিতে তিনটি চরিত্রেরই নাম উল্লেখ করা নেই। এই অনীহাটি কি ইচ্ছাকৃত? এর পিছনে কবির মনে অন্য কোনো ভাবনা কাজ করেছে কি?
কবি : হ্যাঁ নিশ্চয়ই, ইচ্ছাকৃতই নাম দিইনি। এটি তিনবার শ্রুতি নাট্য হিসেবে মঞ্চে অভিনীত হয়েছে এবং কোথাও-ই কখনো কোনো নামের প্রয়োজন হয়নি। এবং দর্শকরাও দেখে কেউ বলেননি এদের কোনো নামের প্রয়োজন আছে।
মৌসুমী- আপনার প্রিয় কবিতাগুলির মধ্যে কোনগুলো বাছবেন। সেই পছন্দ কি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে?
কবি : তা কি বলা সম্ভব? না, নিজের কবিতা আমি ফিরে পড়ি না, আমি সে সময় অন্য কারো বই দু’বার তিনবার চারবার করে পড়ি। ফলে আমার নিজের অমুক অমুক কবিতা ভাল — এরকম কোনো ধারণা আমার মধ্যে তৈরি হয়নি।
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
3 Comments
বাঃ সুন্দর সাক্ষাৎকার হয়েছে ৷ এভাবেই চলুক ...আরও ভালো ভালো মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হোক
ReplyDeleteDarun
ReplyDeleteদীর্ঘ সাক্ষাৎকার, তবু সাবলীল। পড়তে ভালো লাগলো। কবি জয় গোস্বামীর জীবনের আরও কিছু অজানা তথ্য জানা গেল। মৌসুমী ঘোষকে অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDelete