জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে /বিংশতি পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
বিংশতি পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      

প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
বৃন্দাবনের দোল 

        
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন তাঁর সেবা করা যায় পঞ্চরসের মাধ্যমে। এই পঞ্চরস হলো শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রস। আবার এই পঞ্চরসের মধ্যে মধুর ভাবে সকল রসের গুন প্রকাশ হয়। এই রসের ভক্তগন সকলেই শ্রীকৃষ্ণের প্রেমিকা। বিষয়াসক্ত জীবের ভালোবাসার নাম কাম, কিন্তু কৃষ্ণ ভক্তের ভালবাসার নাম প্রেম। বাৎসল্য রসের প্রকাশ পেয়েছে মা যশোদার ভালোবাসায়, কিন্তু মধুর রসের প্রকাশ পেয়েছিল রাধারানী ও গোপীগনের মধ্যে এবং পরবর্তীকালে সাধিকা মীরাবাইয়ের অন্তরে। "মীরার প্রভু গিরিধারী নাগর"। ভাগবতে তাইতো লেখা আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বাসুদেবই একমাত্র পুরুষ আর বাকি সব কিছুই প্রকৃতি। গোপীগনের যে ভালবাসা বা আকুতি তা অন্য কারো মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। শ্রীকৃষ্ণের মোহন বাঁশি শুনতে পেলে তাঁরা যে যে অবস্থায় থাকতেন সবকিছু ত্যাগ করে বাঁশির সুর অনুধাবন করে ছুটে যেতেন। সেই সময় তাঁরা লজ্জা, ঘৃণা, ভয় সব ত্যাগ করতেন। একেই বলে মধুর রস। রাসলীলা, রমণ, শৃঙ্গার প্রভৃতি শব্দের অন্তর্নিহিত তত্ত্ব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলাম।

এই অচিন্তনীয় রাসলীলা প্রত্যক্ষ করার জন্য স্বয়ং মহাদেব গোপিনীর বেশে এসে রাসস্থলীতে প্রবেশ করে রাধাকৃষ্ণের সেই অনুপম নৃত্যগীত দর্শন করার পরে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নাম রেখেছিলেন গোপীশ্বর বা গোপেশ্বর মহাদেব। বংশীবট মন্দির পেরিয়ে গেলে এই গোপেশ্বর মহাদেবের মন্দির। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বৃন্দাবনে এই বংশীবটের তলায় এসে বসার পরে তাঁর ভাবসমাধি হয়েছিল। ভক্ত সুরদাস এই বংশীবট সম্বন্ধে তাঁর শ্লোকে লিখেছেন "কাহা সুখ ব্রজ কেশি সংসার, কাঁহা সুখদ বংশীবট যমুনা, ইয়ে ম্যায় সদা বিচার।" অর্থাৎ সুরদাসের মতে পৃথিবীতে বৃন্দাবনের যমুনা তীরের বংশীবট ছাড়া এমন কোন সুখের স্থান নেই, নন্দগ্রামের মতো কোনো গ্রাম নেই, বংশীবটের মতো কোনো বটবৃক্ষ নেই এবং রাধা কৃষ্ণের মতো সুমধুর আর কোন নাম নেই। শ্রী রাধাগোপীনাথ যে মূর্তিতে বংশী বটের নিচে প্রকট হয়েছিলেন যবন আক্রমণের সময় সেই বিগ্রহ অন্যান্য মন্দিরের ন্যায় জয়পুরে স্থানান্তরিত করা হয় এবং সেই বিগ্রহ আর ফিরে আসেনি। বর্তমানে সেই মূর্তি জয়পুরে পূজিত হচ্ছেন। বংশীবট প্রাঙ্গণে রাধা গোপীনাথের মন্দির ছাড়াও আর একটি মন্দির আছে যেখানে রাধা গোপীনাথের চরণ যুগল পাথরের উপরে রক্ষিত আছে। বহু বৎসর পরে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে রাধা গোপীনাথের এই চরণযুগল আবিষ্কার করেছিলেন কৃষ্ণভক্ত আচার্য শ্রী গিরিধারী শরনদেব। বংশীবট মন্দির পেরিয়ে আমরা গেলাম সুদামা কুটীরে। স্বয়ং সুদামা নিজহস্তে এই কুটীর নির্মাণ করেছিলেন। মন্দির প্রাঙ্গণটি বিস্তৃত এবং সেখানে সুদামা মন্দির ছাড়াও সীতারামের একটি মন্দির আছে যেখানে নিত্য পূজার্চনা করা হয়। সুদামা কুটিরের পরে বাম দিকে গোপেশ্বর মহাদেব যাঁর কথা পূর্বে বললাম। সেখান থেকে আমরা গেলাম লালাবাবু মন্দির। শ্রীরঙ্গনাথজিউ মন্দিরের পিছনে লালাবাবুর এই মন্দির। যদিও এই মন্দিরটি শ্রী রাধা কৃষ্ণচন্দ্রের তথাপি লালাবাবু মন্দির নামে বৃন্দাবনে সমধিক প্রসিদ্ধ। মন্দিরের নামকরণের পিছনে একটি ইতিহাস আছে। 
🍂
অবিভক্ত বঙ্গের মুর্শিদাবাদের বিত্তশালী ব্যবসায়ী শ্রীকৃষ্ণ চন্দ্র সিনহা একদিন নৌকো করে গঙ্গা নদী পার হবার সময়ে শুনতে পেলেন নৌকার মাঝি বলছে 'দিন তো গেল এবারে এগিয়ে চল'। মাঝির এই কথা শুনে চিন্তা করতে করতে গঙ্গা পেরিয়ে তিনি নিজের বাসভবনে গেলেন। পরের দিনে তিনি পদব্রজে এক স্থানে যাবার সময় শুনতে পেলেন এক ধোপা তার স্ত্রীকে বলছে 'দিন তো শেষ হতে চলল এবারে বাসনাতে আগুন দাও'। পরপর দুদিন একই রকম অর্থবোধক কথা শুনে লালাবাবু চিন্তা করলেন সত্যই তো জীবনের দিনগুলি একে একে পেরিয়ে যাচ্ছে। এবারে বিত্ত-বাসনা ত্যাগ করার সময় হয়েছে। যে মুহূর্তে এই কথা তাঁর মনে হল তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সংসার, বিরাট ব্যবসা, পূর্ববঙ্গের জমিদারি সমস্ত ত্যাগ করে ভগবানের নাম করার সময় হয়েছে। এই চিন্তা করে তিনি তাঁর ব্যবসা, জমিদারীর সমুদয় সম্পত্তি বিক্রয় করে সংসার ত্যাগ করে বৃন্দাবনে চলে এলেন ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে। এখানে এসে ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি শ্রীরাধা কৃষ্ণচন্দ্র এবং সখী ললিতার এই মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের চতুর্দিকে দেওয়াল চিত্রের মধ্যে  সম্মুখভাগে নৃসিংহদেবের চিত্র এবং দক্ষিণ পার্শ্বে বরাহদেবের চিত্র দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। মন্দিরের গর্ভ মন্দিরে রাধা কৃষ্ণচন্দ্রের বিগ্রহ এবং সখী ললিতা দেবীর বিগ্রহ। সম্মুখের দেওয়াল চিত্রগুলি কালের অবক্ষয়ে ক্ষীযমান, যদিও সেগুলি মাঝে মাঝে রং করা হয়। মন্দিরের পিছনে ফুলের সুন্দর বাগান। এত সুন্দর মন্দির নির্মাণ করেও লালাবাবু কিন্তু কোনদিন সেই মন্দিরে বাস করতেন না। রাধারানী ও কৃষ্ণচন্দ্রের অশেষ কৃপাবলে মন্দির নির্মাণের এক বৎসর পরে তিনি গোবর্ধনে যেয়ে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। লালাবাবু ও তাঁর স্ত্রীর সমাধিমন্দির তারের জাল দিয়ে ঘেরা। মৃত্যুকালে তিনি নির্দেশ দিয়ে গেছলেন তিনি যেমন দীনহীন বৈষ্ণব তাঁর সমাধি মন্দির যেন সেই ভাবেই রক্ষিত হয়। কোনোরকম আড়ম্বর সেখানে যেন না করা হয়। বৃন্দাবনে আসার পূর্বে, যদিও তিনি একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী ছিলেন তথাপি কৃষ্ণ প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে সমস্ত কিছু ত্যাগ করে যখন তিনি বৃন্দাবনে এলেন তখন তিনি নিষ্কাম বৈষ্ণবের মতো ভিক্ষা করে ভিক্ষালব্ধ অর্থে কালাতিপাত করতেন। লালাবাবু মন্দির দর্শন করার পরে সেদিন আমরা আর কোথাও যেতে পারিনি। এখান থেকেই আমরা একটি টোটো করে আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমে ফিরে গেলাম। 

দোলযাত্রার পরের দিনে সকালবেলা আমরা মথুরা বৃন্দাবন রোড ধরে আমাদের আশ্রম থেকে কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে মাধোবিলাস মন্দির দেখতে গেলাম। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে জয়পুরের মহারাজা সোয়াই মাধো সিং এই মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। ১৯১৭ সালে নির্মাণকার্য শেষ হওয়ার পরে মন্দিরে শ্রীরাধা মাধবের বিগ্রহ স্থাপন করেন। সমগ্র মন্দিরটি রাজপুত ঘরানায় নির্মিত। মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে পাথর বাঁধানো পথ দিয়ে কিছুটা হেঁটে গেলে সুবিশাল এবং সুন্দর এই মন্দির। মন্দিরের সারা গায়ে অপূর্ব খোদাই কাজ। গর্ভমন্দিরে মূল বিগ্রহ শ্রীরাধা গোবিন্দ সহ অষ্টসখীর, ডানদিকে হংসবিহারী, বাঁদিকে আনন্দবিহারী গিরিধারী গিরিরাজ গোবর্ধনকে ধারণ করে রয়েছেন। মহারাজা সোয়াই মাধোসিং তাঁর গুরুদেব ব্রহ্মচারী গিরিধারী শরণজীর প্রেরণায় এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। মন্দিরের প্রশস্ত প্রাঙ্গনে অনেকগুলি রিজার্ভ বাস দাঁড়িয়ে আছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুণ্যার্থী নরনারীরা এই বাসগুলিতে এসে বৃন্দাবন দর্শন করছেন। মন্দির থেকে বেরোবার পথে এইরকম একটি বাসের এক যাত্রীর সাথে আলাপ হলো। এঁরা ঝাড়খণ্ডের চাস থেকে এসেছেন। ভদ্রলোকের নাম মনোহর শর্মা। এঁরা মোট ৬৫ জন এসেছেন ওঁদের নিকটবর্তী স্থান থেকে। পথিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় রাত্রিবাস করে গতকাল বৃন্দাবনে এসে পৌঁছেছেন। ১৪ই মার্চ ঝাড়খন্ড থেকে বেরিয়ে ফিরবেন ৩রা এপ্রিল। এখান থেকে বেরিয়ে গোকুল, গোবর্ধন দেখে সোজা উত্তরে বৈষ্ণদেবী দর্শনে যাবেন। কথায় কথায় মনোহর শর্মা বললেন গ্রামবাড়িতে তাঁর আট একর ধানি জমি আছে। দুই ছেলে প্রাইভেট টিউশনি করে। স্ত্রীকে নিয়ে এই অযাচক ব্রাহ্মণ তীর্থ দর্শনে বেরিয়ে পড়েছেন। ওঁর কথাগুলি শুনে এবং ওঁদের দেখে মনে হল ভারতবর্ষের পূণ্যার্থী নরনারীরা এখনও যে যেভাবেই হোক এই তীর্থ দর্শন করে পুণ্য অর্জন করেন, যেমন ভাবে আমরাও এসেছি। এখান থেকে ফিরে এসে আর কোথাও যাওয়া হলো না। 
    ( পরবর্তী অংশ একবিংশতি পর্ব)

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

1 Comments

  1. পড়লাম।পরের পর্বের অপেক্ষায়

    ReplyDelete