উদয়ের পথে
চতুর্দশ পর্ব
মলয় সরকার
১৩০০ ইয়েন দিয়ে টিকিট কেটে ঢুকলাম প্যালেসে। ঢোকার মুখে রয়েছে একটি সুন্দর চীনা ঢঙের বেশ রাজকীয় গেট। এতে সুন্দর ঢেউ খেলানো কাঠের কারুকাজ রয়েছে যা অনেকটাই সোনালী রঙের।এটিই নিনোমারু প্রাসাদের সুসজ্জিত গেট।গেট দিয়ে ঢুকে বেশ একটু প্রশস্ত জায়গা । তাতে রয়েছে বেশ কিছু সাজানো গাছ, পাইন এবং অন্যান্য ।তবে এটা ঠিক যে, এই সুন্দর গেটটির বিশেষত্ব চোখ টেনে নেবেই। এই গেটটির নাম কারামন গেট (Kara mon gate) ।এটিতে নাকি, সাইপ্রেস গাছের ছাল ব্যবহার করা হয়েছে এর কারু কাজে।
সম্রাট Tokugawa Ieyasu র ইচ্ছায় এই নিনোমারু প্রাসাদ ১৬০৩ খ্রীষ্টাব্দে তৈরী হয়।তিনিই এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রায় ২৬০ বছর ধরে, ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত তাঁর বংশের প্রাধান্য কায়েম থাকে জাপানে। তিনিই নাকি সমগ্র জাপানকে এক ছাতার তলায় আনেন।সেই হিসাবে এই নিজো জো ক্যাসলই জাপানের ইতিহাসের মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের শুরু এবং শেষের সাক্ষী।এর পর আরম্ভ হয় মেইজি (Meiji) বংশের রাজত্ব।এই মেইজি রাজত্বই জাপানে নতুন যুগের সূচনা করে এবং আজকের আধুনিক জাপানের জন্ম শুরু হয় তখন থেকেই ।
১৯৩৯ সালে এই ক্যাসলটি শহরবাসীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এর পর এটি ইউনেস্কো হেরিটেজ তকমাও লাভ করে।
এই প্রাসাদ পাঁচটি বড় বাড়িকে একসঙ্গে করিডোর দিয়ে জুড়ে তৈরী করা হয়েছে। মূল প্রাসাদে ঢোকার আগে জুতো খুলে ঢুকতে হয়। এটি মূলতঃ কাঠের তৈরী।এই পদ্ধতি হল জাপানের বিশেষ পদ্ধতি shoin-zukuri। এখানে ব্যবহৃত হয়েছে প্রায়ই সাইপ্রেস গাছের কাঠ।এখানে ঘরগুলির সংখ্যা মোট তেত্রিশ, যেগুলি মূলতঃ বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কানো তান্যু (Kano Tanyu)(১৬০২-৭৪)এর তত্বাবধানে ৩০০০ আঁকা ছবি দিয়ে সাজানো। এই ছবিগুলি আঁকা হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে।প্রতি ঘরের দেওয়ালে রয়েছে বিশাল বিশাল জাপানী রীতিতে আঁকা ছবি, যেগুলি আমাদের দরজার কাছ থেকেই দেখে সাধ মেটাতে হল। কাছে যেতে দেওয়া হয় না। যদিও আমি ছবি বিশেষজ্ঞ নই, তবু আমার বোধ হল, ছবিগুলি কোনও রকম মেদবাহুল্য বর্জিত , সহজ বোধ্য ও সরলতায় ভরা। শিল্পীমনের , প্রকৃতি ও নৈসর্গিক চেতনার প্রাধান্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা এই প্রত্যেকটি ছবিই, যাঁরা ছবি ভালবাসেন , তাঁদের মন কেড়ে নেবেই এবং ছবির প্রকৃত সৌন্দর্য্যের দিকটা ভাবতে অবশ্যই সাহায্য করবে। ছবি বেশিরভাগই প্রকৃতি, পাখী, তুষার, চেরী, পাইনের বন ইত্যাদি দিয়েই আঁকা।রবীন্দ্রনাথ যে কেন জাপানী রীতির অঙ্কনশৈলীতে মুগ্ধ হয়েছিলেন, বোঝার চেষ্টা করতেই পারি।এখানে আবার ছবি তোলা কঠিন ভাবে নিষিদ্ধ। কাজেই ইচ্ছা থাকলেও কোন ছবি নেওয়া হয় নি।
ক্যাসলে ঢোকার টিকিট কাউণ্টার
একের পর এক ঘর, বারান্দা বা করিডোর দিয়েই পর পর কাঠের তৈরী ফাঁকা বড় বড় ঘরের সামনে দিয়ে যেতে হল।এখানে ঘরে প্রায় ৮০০ মাদুব ব্যবহার করা হয়েছে সাজানোর জন্য। এখানে মেঝেতে পা দিলে পাখীর ডাকের মত আওয়াজ হয় বলে, এদের নাম uguisu bari (nightingale floors)। একটি ঘরে দেখলাম, সম্রাট সভাসদদের সঙ্গে মাটিতে বসে আলোচনা বা পরামর্শে রত ,এমন মানুষ সমান মূর্তি করা রয়েছে।এমন ভাবে মূর্তিগুলো করা আছে, হঠাৎ দেখলে সত্যিকারের মানুষ বলেই ভ্রম হবে।
এই বসার ব্যাপারে একটু বলে নিই। জাপানীদের বসার কিন্তু এক বিশেষ রীতি আছে।এদের সাধারণ ভাবে বসা হত মাটিতেই একটা কাঠের আসনে।ভদ্র সমাজে বসার রীতি মেয়ে পুরুষ সবারই পা পিছনে মুড়ে।এই পদ্ধতিকে বলে সিজা(Seiza)। তবে সাধারণ ভাবে ছেলেরা পা মুড়ে ক্রশ করে বসে এবং মেয়েরা পা মুড়ে বসে। এরা খাওয়া দাওয়া করে নীচু টেবিলে।
🍂
কাজেই সম্রাটের সামনে যাঁরা বসে আছেন বা কথা বলছেন, সবাই মাটিতে পা মুড়ে বসে আছেন। এটাই ওখানকার ভদ্রতা।
এছাড়া ওখানে রয়েছে বেশ কিছু জাপানী রীতিতে তৈরী বাগান আর ছোট ছোট কৃত্রিম জাপানী পদ্ধতিতে তৈরী জলাশয়। সব নিখুঁত এবং পরিচ্ছন্ন।এই জলাশয়ের ধারে যে পাথরগুলো রয়েছে সেগুলোরও নাকি বিশেষ বিশেষত্ব আছে এবং সেগুলো যত্ন করেই ওভাবে সাজানো আছে। এই জলাশয় গুলিতে এই সমস্ত পাথর দিয়ে তিনটি বিশেষ দ্বীপের মত করা আছে। তাদের নাম Hōrai-jima (Island of Eternal Happiness), Tsuru-jima (Crane Island) এবং Kame-jima (Turtle Island)। সমস্ত বুঝব এতটা শিল্প বিশেষজ্ঞ আমি নই, তবে সামগ্রিক ভাবে বলতে পারি বেশ সুন্দর লাগছে। নিনোমারু প্রাসাদের এই বাগানটির পরিকল্পনা ও সৃষ্টি বিখ্যাত শিল্পী Kobori Enshu (1579-1647 CE)র।সম্রাট Go-Mizunooর এখানে আগমন উপলক্ষ্যে এটি তৈরী হয়।
এছাড়া আরও একটি বাগান রয়েছে এই নিনোমারু প্রাসাদের পাশে যার নাম Seiryu-en Garden, এবং এটি তৈরী হয় ১৯৬৫ সালে।
হোনমারু অংশ বা ভিতরের অংশে যে আসল রাজবাড়ি ছিল, তা একসময় ১৭৫০ সালে বাজ পড়ে তার আগুনে নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও ১৭৮৮ সালে এক বিশাল বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে সব ভস্মীভূত হয়ে যায়।
পরে এটিকে আবার নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। তবে সাধারণতঃ এটি সাধারণের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ।
এখানে পূর্বদিকে একটি গেট আছে যার নাম Higashi Ote-mon Gate (East Gate)। এটি সম্ভবতঃ
১৬৬২ সালে তৈরী হয়েছিল। এটি প্রথমে দ্বিতল গেট ছিল। কিন্তু পরে এটিকে একতলা করা হয়। কারণ উপর থেকে কেউ সম্রাটকে দেখলে তা হবে সম্রাটের অবমাননা। তাই তার সম্ভাবনাকে ছেঁটে ফেলতে এই আদেশ দেওয়া হয়।
ক্যাসলের ভিতরে বাগানে
এখানে বাগানে প্রচুর রডোডেন্ড্রন ও ক্যামেলিয়া ফুলের সমারোহ দেখলাম।এ ছাড়াও চেরী তো রয়েইছে, সঙ্গে এজেলিয়ার বাহারও অনেক দেখলাম।এখানে রয়েছে অনেক ধরণের ক্যামেলিয়া (Tsubaki)।প্রায় শতাধিক ধরণের ক্যামেলিয়ার ৪০০ টি গাছ এখানে আছে বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন।এই ক্যামেলিয়া জাপানের ঐতিহ্য সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আর একটি গাছ হল চেরী গাছ, যা জাপানের নামের সাথে সমার্থক হয়ে গেছে। জাপান আর চেরীকে আলাদা করা যায় না।বলা হয় প্রায় ৫০ প্রজাতির ৪০০ গাছ আছে এখানে। একে জাপানী ভাষায় বলে (Sakura)। এ ছাড়াও নানা গাছের সঙ্গে আছে জাপানী প্লাম Japanese Plum (Ume)। সেটিরও প্রায় ১৩০ টি গাছ আছে। এই হিসাব থেকেই পাঠক বুঝতে পারবেন ,সে বাগান কত সুন্দর ভাবে সাজানো।এরকম একটা বাগানে ঢুকলে, রাজবাড়ির ঐশ্বর্যও তার কাছে হার মানে। তবে জাপানীদের সৌন্দর্যপ্রীতি তো জগদবিখ্যাত। তার উদাহরণ এখানে বোঝাই যাচ্ছে। আমাদের তখন রসের হাঁড়িতে মাছি বসার অবস্থা। এত সৌন্দর্যের আকর্ষণে পা আর চলতে চায় না ,ওদিকে সময় তাড়া দিচ্ছে নিষ্ঠুরের মত। যেতেই হবে।এখানে সুন্দর লন, তার মাঝে সুন্দর রাস্তা। বাগানে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ছোট দোকানে বসার ,চা খাওয়ার ব্যবস্থা, ওয়াশরুমের ব্যবস্থা সবই আছে।
এখানে অনেক জায়গাতেই দেখলাম বাঁশের দেওয়াল বা দরজা কি বেড়া। এই বাঁশও অবশ্যই বড় বড় সুন্দর সরল বাঁশ।হবে বৈ কি রাজ বাড়ির বাঁশ তো! সে কি আর গরীবের বাড়ির বাঁশ হতে পারে!
এখানকার বাগানে।
যাই হোক, রাজবাড়ি থেকে রাজপথ হয়ে আমরা যাব গ্রামের পথে পথে। সঙ্গে থাকুন বন্ধুরা। আমরা পথিক, চলতে থাকি চলতে থাকি সুন্দরের খোঁজে–
ক্রমশঃ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments