জ্বলদর্চি

রবি ঠাকুর সহজ পাঠের ঠাকুর/ রাজীব শ্রাবণ

রবি ঠাকুর সহজ পাঠের ঠাকুর 

রাজীব শ্রাবণ 


তখন সবে আধো আধো কথা ফুটছে । অ- আ - ক - খ শুরুর শুরু। হাতে পেয়েছিলাম 'সহজ পাঠ‌ '। শিশু মনে সহজ করে ছাপ ফেলেছিল। 'কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি' কবিতাটা বাবার মুখে মুখে পড়ে পড়ে মুখস্ত করেছিলাম।আজও গড়গড় করে আমার মতো আপামোর বঙ্গবাসী রণে বণে যেখানে খুশি বলতে পারে। সহজপাঠের সাদাকালো ছবিগুলো দেখে কি যে মজা  পেতাম কি বলবো! পঙ্গপালের চেহারা দেখে খুব ভয় পেয়েছিলাম, ওটা কী বারবার মাকে জিজ্ঞাসা করতাম।

এরপর শিখলাম বীরপুরুষ‌। সে কী গর্ব আমার! ভাবতাম যদি কখনো সুযোগ পাই মাকে বাঁচানোর, ঝাঁপ দিয়ে লড়াই করব। স্কুলের ফাংশনে বন্ধুদের সাথে হাত ধরে নাচলাম - 'আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি'। আর এভাবেই আমার পরিচয় তোমার সাথে।

‌'কাবুলিওয়ালা, ও কাবুলিওয়ালা, তোমার ঝুড়িতে কি আছে গো?'... 'হাথি আছে খোকি, হাথি' - এই আমার শৈশব। ছোটবেলায় নিজেকে মিনির থেকে বিন্দুমাত্র আলাদা ভাবতাম না, মায়ের পুরানো শাড়ি পড়ে কতবার হাত ঘুরিয়ে নেচেছি - 'কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে'।

এরপর স্কুলে যখন 'ছুটি'র ফটিকের সাথে পরিচয় হল, ফটিকের দস্যিপনার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেও দুষ্টুমি করতাম। তখন আমার সে কি আনন্দ! কিন্তু ফটিকের অত তাড়াতাড়ি ওই ভাবে চলে যাওয়াটা যখন জানতে পারলাম তখন ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম আর বললাম 'আমাকে দূরে পাঠাবে না তো?' মা অবাক হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল।

সেবার জ্বরে অনেকদিন ভুগেছিলাম, স্কুলে যেতে পারতাম না। দুপুরে জানালার শিক ধরে বাইরে তাকিয়ে বসে থাকতাম আর নানা ফেরিওয়ালাকে যেতে দেখতাম। মনে হতো তখন আমি বোধহয় সেই অমল। 'ইচ্ছেপূরণ' পড়তে পড়তে বারবার মনে হত সত্যিই যদি আমি বাবা হয়ে যেতাম আর বাবা আমি, ভারী মজা হতো তাহলেl

তারপর আস্তে আস্তে বড় হলাম আর তোমার সাথে পরিচয় বাড়তে লাগল। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গান, নাচ জীবন জুড়ে শুধু তুমি। ভালোলাগা, না ভালোলাগা, ভালোবাসা, রাগ, দুঃখ, অভিমান সব কিছুতেই তোমাকে পেতাম। বইমেলা থেকে 'গীতাঞ্জলি' কিনে আনলাম আর জন্মদিনে পেলাম 'গল্পগুচ্ছ'। 'ঘাটের কথা', 'বিসর্জন', 'মানসী', 'দেনাপাওনা', 'চিত্রাঙ্গদা' এভাবেই আমার পড়ার নেশা বাড়তে লাগলো।

যৌবনে 'চোখের বালি', 'নৌকাডুবি' কতবার পড়েছি। 'মানভঞ্জন', 'ঘরে বাইরে' পড়তে পড়তে রাত ভোর হয়ে যেত। প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ সবকিছুর মধ্যেই তোমার গান কে পেতাম, তোমাকে পেতাম। 

এরপর আরো বড় হলাম, জীবন আরো জটিল হলো, সংসার হলো, ব্যস্ততা বাড়লো। কিন্তু তুমি থাকলে সেই তোমার জায়গায়। তাই ভালোলাগা, না ভালোলাগায়, আমি আজও গেয়ে উঠি - 'ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে' অথবা 'আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে' কিংবা 'তোমার খোলা হাওয়া'...

🍂

যত বড় হয়েছি, বুঝেছি কাবুলিওয়ালার মত তোমারও একটা ঝুলি আছে আর তাতে যতবার হাত ঢোকাই পরশ পাথর পাই। মা'কে ভালোবাসা, ভাইকে ভালোবাসা, দেশপ্রেম, প্রেমিকের প্রেম, বন্ধুত্বের বন্ধন, সন্তান স্নেহ, আর ঈশ্বরকে খোঁজার চেষ্টা - এ সব কিছুই আমি আর বোধকরি সমগ্ৰ বাঙালি জাতি তোমার থেকেই শিখেছি। 

সবশেষে তাই বলি 'শেষের কবিতা' থেকে - আমাদের এই জাগতিক ভালোবাসা ঠিক একটা কলসির মত, রোজ সকালে জল ভরি আর সারাদিন ব্যবহার করি। কিন্তু তুমি, তুমি হলে দিঘি, অথবা সমুদ্র কিংবা মহাসমুদ্র। তোমার গভীরতা অসীম, তোমাকে ঘরের এই চার দেওয়ালের মাঝে বাধা যায় না, তোমাকে পেতে গেলে ঐ সাগরে ডুব দিতে হবে, আর সেখানেই পাওয়া যাবে অমৃতরসের সন্ধান। আর তাইতো আজ গাই - 

'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।।'

ভালো থেকো কবি...সবাইকে ভালো রেখ তোমার সৃস্টি দিয়ে।

Post a Comment

2 Comments

  1. AnonymousMay 14, 2024


    I always enjoy reading your writings. Superb sir keep it up. always with you.

    ReplyDelete
  2. AnonymousMay 15, 2024

    দারুন লেখা আপনার, অনেক কিছু নতুন শিখতে ও জানতে পারি।

    ReplyDelete