বাংলাদেশ সফর
পর্ব- ১
রোশেনারা খান
‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া .....’
এই রকমটাই হয়। এশিয়া থেকে ইউরোপ পাড়ি দিয়ে বেশ কয়েকবার ইউকে বেড়ানো হয়ে গেছে, কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যা এক সময় আমাদের রাষ্ট্রের শুধু নয়, এই বাংলার অংশ ছিল, সেই বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত এই স্থানটিকে খুব ছোট খেকেই চিনতাম। কারণ ছোটকাকা মুজিবর রহমান খান ভাল চাকরির জন্য পূর্ব পাকিস্থান গিয়ে ওখানেই সেটেল হয়েছিলেন। জেলাজজ হিসেবে কাজে যোগ দিয়েও নিয়মিত সঙ্গীত চর্চা করতেন এবং ঢাকা রেডিওর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। বাবাকে চিঠি পাঠিয়ে কাকা তাঁর অনুষ্ঠানের দিন ও সময় জানিয়ে দিতেন। আজও মনে পড়ে পাড়ার লোক উঠোনে ভিড় করে সেই গান শুনতেন। কাকা-কাকিমা ছেলেদের নিয়ে মাঝে মাঝে দেশে আসতেন।সে সব এক দিন ছিল।
তারপর তো ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ হল। বঞ্চনা সইতে সইতে পূর্ব পাকিস্থানের বাঙ্গালিরা একদিন রুখে দাঁড়াল। তরুণদল স্বাধীনতার জন্য অপটু হাতে তুলে নিল আগ্নেয় অস্ত্র। যুদ্ধ চলল মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। মনে আছে এই যুদ্ধে রোশেনারা নামে এক তরুণী বুকে মাইন বেঁধে খান সেনাদের ট্যাংকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। আমার নাম ও ‘রোশেনারা’ হওয়াতে মনে মনে খুব গর্ব অনুভব করেছিলাম।
এই যুদ্ধে জয় হল বাঙ্গালিদেরই। পাকিস্থান থেকে পূর্ববঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে যে নতুন দেশের জন্ম হল, তার নাম ‘বাংলাদেশ’।এর পর সারা বিশ্ব জানল বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্র আছে, যেখানে বাঙ্গালিরা বাস করেন, তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা। সত্যি বলতে কী, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে্ বাংলা দেশের বাঙ্গালিরাই। বলা যায় এঁরাই বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।
বাংলাদেশের বাঙ্গালিদের সংস্কৃতি, ভাষা, তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কেমন তা জেনেছি ২০০৮ সালে ইংল্যান্ড গিয়ে। ওখানে বাংলাদেশের বেশকিছু টিভি চ্যানেল দেখা যেত। ওখানেও ওদের নিজস্ব স্টুডিও ছিল। সেখান থেকে কিছু লাইভ প্রোগ্রাম প্রচারিত হত। যাইহোক, বাংলাদেশের নাটকগুলি এত ন্যাচারাল যে মনেই হবেনা এটা সিরিয়াল বা নাটক দেখছি। এই সময় থেকেই বাংলাদেশ দেখার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে। খুড়তুতো ভাইয়েরা ডাকে, কিন্তু সাংসারিক অসুবিধার জন্য হয়ে ওঠেনি। বেশ কয়েকবার ওদেশের বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন থেকে ডাকও পেয়েছিলাম, কিন্তু খান সাহেব অসুস্থ থাকায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। গত বছরই ভেবেছিলাম সামনের বছর যেভাবে হোক যাবই যাব।২০২৩ শে ইংল্যান্ড গেলাম, ফিরলাম সেপ্টেম্বরে। ২০২৪ শে জানুয়ারি থেকেই বাংলাদেশ যাওয়ার কথা ভাবছিলাম।শীতের মধ্যেই যেতে হবে,না হলে গরমে কষ্ট হবে। কিন্তু কপালে কষ্ট থাকলে খণ্ডাবে কে? কক্সবাজার থেকে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কবিতা পরিষদ সম্মাননা’ দেবার জন্য তাঁদের বৈশাখী কবিতা উৎসব ১লা এপ্রিল আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হল। এর আগে বাংলাদেশের কবিতা নগরী কক্সবাজারে ১লা মার্চ অনুষ্ঠিত কবিতা উৎসবে যোগ দেবার জন্য এবং ‘আলোকিত ফজিলাতুন্নেসা’ সম্মাননা গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিল ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কবিতা পরিষদ থেকে। কিন্তু অসুস্থতার জন্য সেই সময় যাওয়া সম্ভব হয়নি। ভেবেছিলাম এবছর আর যাব না। কিন্তু ওনাদের ডাক ফেরানো গেলনা। কবি ও সাংবাদিক শাকিল আহমেদের উদ্যগে আমাদের ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ রওনা হওয়া ঠিক হল।
ওইদিন দুপুর ১২ টার মধ্যে সবাইকে শিয়ালদা স্টেশনে মেন এনকোয়ারির সামনে হাজির থাকার জন্য বলা হয়েছে।আমি ও সেইমত ড্রাইভারকে সকাল ৮টা তিরিশের মধ্যে আসতে বললাম। মেদিনীপুর শহর থেকে শিয়ালদা স্টেশন পৌঁছানোর জন্য ৩ ঘণ্টা সময় হাতে রাখতেই হবে। ১৮ তারিখ সকালে উঠে আর একবার সব দেখে নিলাম।ওষুধ, বিস্কু্ট চিড়ে বাদাম ইত্যাদি কিছু শুকনো খাবার নিয়েছি, টাকা একটু বেশিই নিয়েছি।আর নিয়েছি সাড়ি ইত্যাদি।
পেট্রাপোল যাওয়ার পথে বড় বড় গাছ
সকালে চা খাওয়ার পর স্নান করে সামান্য আলুসেদ্ধ ভাত খেলাম আর তো ভাত খাওয়া হবে না। কোথায় কী হবে? কিছুই জানিনা, আমি বলেছি খাওয়ার থেকে জরুরি ওয়াসরুম, ওটা চাই। যাইহোক ১১টা ৩০ এর মধ্যে শিয়ালদা পৌঁছে কাউকেই দেখতে পেলাম না। তারপর ২/১ জন করে মোট ৯ জন এক জায়গায় হলাম।১০ জনের যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে গীতিকার ও কবি অরুণ চক্রবর্তী অসুস্থতার কারণে বাংলাদেশ যাওয়া বাতিল করেছেন।শাকিল ছাড়া আর যারা যাচ্ছেন তাঁরা কেউ শিক্ষকতা করতেন, কেউ এখনো করেন। এদের মধ্যে গৌতম মণ্ডল ও সরস্বতী পোদ্দার নিয়মিত লেখালিখি করেন।
🍂
কিছুক্ষণের মধ্যেই বনগাঁ লোকালে চড়ে বসলাম, আমি ছাড়া বাকিরা লেডিসে উঠব না বলেও উঠে পড়েছেন। আমাদের যাত্রা শুরু হল। বেশ গরম, তার ওপর মালের দায়িত্ব যে যার নিজের। শাকিল বলেছিলেন হাল্কা লাগেজ নিতে, কিন্তু মহিলাদের জামাকাপড় একটু বেশি লাগে। তার ওপর শুকনো খাবার, ছাতা, জল ঠাণ্ডা রাখার বোতল ইত্যাদি অনেকটা জায়গা নিয়েছে। সেইসঙ্গে ভারিও হয়েছে। যাইহোক, গল্প করে ,এটা সেটা খেয়ে একটা সময় বনগাঁ পৌঁছালাম। ওখান থেকে টোটোতে চড়ে চললাম বর্ডার। ইমিগ্রেসনে বেশ সময় লাগল। প্রথম বার যাচ্ছি বলে আমাকে একটু বেশি ঝামেলা পোয়াতে হল। এর মধ্যে একজন কোথায় ব্যাগ ফেলে চলে এসেছেন, শাকিল তার সঙ্গে ব্যাগ খুঁজতে গেলেন। এদিকে ৭৩/৭৪ বছরের এক বৃদ্ধা (তাঁর দুটি হাঁটুতেই অস্ত্রপ্রচার হয়েছে)সামনে ফাঁকা জায়গা ছিল, বুঝতে না পেরে পা বাড়িয়ে পড়লেন দড়াম করে।
এখন বোমাতঙ্কে, পড়ে থাকা ব্যাগে সচরাচর কেউ হাত দেন না বলে অঙ্কনার ব্যাগটা পাওয়া গেছে। আর যিনি আছাড় খেয়েছিলেন, সেই মায়াদির ও খুব বেশি আঘাত লাগেনি। এখানে যে শাকিলের দালাল বা এজেন্ট আছে তাদের অফিসে বসলাম। এখানে এসে জানলাম শাকিল এখান থেকে কক্সবাজার যাওয়ার জন্য কোনও বাসে সিট বুক করেননি।এখন ওই রুটের কোনও টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। রাত হয়েছে বেশ। আমরা সবাই পাশের একটি রেস্টুরেন্টে মাছ-ভাত দিয়ে ডিনার করলাম। শেষপর্যন্ত ঠিক হল ঢাকা হয়ে কক্সবাজার যাওয়া হবে। টিকিট করে নিয়ে আসা হয়েছে। স্লিপার কোচ, শুয়ে বা ঘুমিইয়ে যাওয়া যাবে। ভিতরটা ঠিক পাল্কির মত। আমাদের দেশে বহুদিন আগে মহাবালেশ্বর থেকে নামার সময় স্লিপার কোচে চড়েছিলাম, বাস যখন গোঁ গোঁ করে নিচে নামছিল, ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম।এখানে অবশ্য সমতল রাস্তায় বাস ছুটছে। আমি এইটুকু জায়গায় ঘুমোতে পারিনা। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে যাবে।
(ক্রমশ)
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী
1 Comments
যেখানেই যাবে, মনে রাখবে এই ছায়াপাঠক সঙ্গে আছে। শুভেচ্ছা অফুরান।
ReplyDelete