সপ্ত বিংশ পরিচ্ছেদ
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
পরের সকালে তুমুল ব্যস্ততা। সক্কাল সক্কাল স্নান ও প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে সবাই মিলে গাড়িতে উঠলেন।যথারীতি বিরজা বসেছিলেন পিসিমার পাশেই।টুকটাক গল্প চলছিল মা মেয়ের। দেশে ফেলে আসা ঘর সংসারের, এখানকার পাহাড়ি পথের, নতুন আলাপ হওয়া পরিবারটির সম্বন্ধে। মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি, সেদিনকার পথ আগের দিনের মতো মসৃন নয়। তবে কাঁচের জানলার বাইরে চোখ রাখলে বাইরের দৃশ্যাবলী অসাধারণ ঠেকছিল বিরজার। চকচকে নীল আকাশ, নিচে সূচালো পাতাওয়ালা গম্বুজের আকৃতির গাছ, দাদার কাছে জেনেছেন ওদের কারও নাম পাইন,কারও নাম ফার। শীতের বেলায় যখন খুব বরফ পড়ে আকাশ থেকে,তখন ওদের গায়ে পাতায় বরফ জমে ওদের যেন মেরে না ফেলে, তাই এমন আকৃতি। এবং রুদ্রাক্ষের গাছ। ভাবতে অবাক লাগছিল, যে জপমালা আসমুদ্র হিমাচলের পূজা ও সাধনার অন্যতম উপকরণ, মহার্ঘ্যও বটে;তা ছড়িয়ে রয়েছে অযত্নে ইতস্তত গাছের তলায়। দাদার অনুমতি নিয়ে কয়েকটা ফল কুড়িয়ে নিয়ে যাবেন, এমন ইচ্ছে ছিল মনে, এনেও ছিলেন বেশ কিছু সঙ্গে করে। পরে সেসব কোথায় যে হারিয়ে গেছে,জীবনের আরও অনেক মহার্ঘ্য সম্পদের মতোই!
ওদিকে গাড়ি এগিয়ে যেতে যেতে একসময় বারোকোট পেরিয়ে উত্তর কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরে পৌঁছয়। চারিদিকে পাহাড়, মাঝে খানিক সমতলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে মহাদেব মন্দির, যাকে মহাকাল দেবতাও বলা হয়। পাশেই কুন্ড, স্নানের ব্যবস্থা আছে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে মন্দিরে প্রবেশ করলেন সকলে।বাইরের উজ্জ্বল রোদ বরফঘেরা পাহাড়ে পিছলে পড়ে চোখ ঝাঁঝিয়ে দিচ্ছে,হু হু করে বয়ে যাওয়া হিমেল বাতাস গায়ে সূচের মতো বিঁধে। কিন্তু মন্দির ফটকে পেরোলেই এক অদ্ভুত অনুভূতি,গর্ভগৃহের তাপমাত্রা যথেষ্ট বেশি,খানিকক্ষণের মধ্যেই আরাম বোধ হয়। বাইরের হাওয়া প্রবাহের তীব্রতা নেই, ভারী পাথরের দেওয়াল ঘেরা মন্দির।স্বাভাবিক ভাবেই সুরক্ষিত। প্রথমে ভেবেছিলেন, এতগুলি মানুষের নিঃশ্বাস নিঃসরণের জন্য হয়তো এমন উষ্ণতা, কিন্তু পরে দাদার কাছে শুনেছিলেন, এটিই নাকি পবিত্র স্থানটির মাহাত্ম্য। তুষারপাত হলেও নাকি মন্দির অভ্যন্তরে তার প্রভাব পড়ে না। আবার যত বেশি জনসমাগমই হোক না কেন,একটিমাত্র দরজা বিশিষ্ট জানালাহীন কক্ষটিতে কখনো বায়ুহীনতার জন্য কোন দুর্ঘটনাও ঘটেনি। কারন, জনশ্রুতি, প্রবেশ মুখের ঘন্টা বাজিয়ে দ্বার পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই ভক্তের দায়িত্ব নাকি ভগবানের। কি অপরূপ লোক বিশ্বাস! কি অপূর্ব স্থাপত্য কৌশল!
🍂
আরও পড়ুন 👇
যাহোক,বহুদূর থেকে বহু যত্নে বয়ে আনা বাড়ির গাছের আম দিয়ে ডালা সাজিয়ে পূজা অর্চনা এবং যথাবিহিত মন্দির প্রদক্ষিণ শেষে যখন বাইরে এলেন বিরজা, দেখলেন ভিক্ষার ঝুলি হাতে সামনেই এক তরুণ সাধু। টকটকে গৌরবর্ণ নগ্ন দেহে মধ্যাহ্নের সূর্যালোক এক মায়াময় দীপ্তি ছড়াচ্ছে… মুখে প্রশান্ত হাসি। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে ভিক্ষে চাইলেন। কি অপরূপ দৈবীভাবে আবিষ্ট পূজারিনী যেন প্রতীক্ষায় ছিলেন তাঁকে আজন্ম সঞ্চিত ভিক্ষাটুকু দেওয়ার, কিচ্ছু না ভেবেই পাঁচটি আম তুলে দিলেন তাঁর বাড়িয়ে দেওয়া ঝোলায়, উৎসর্গক্ষণ যেন ব্যর্থ না হয়…জগৎ ভরে শঙ্খনাদে উঠল মহাধ্বনি, “শুভমস্তু”...”শুভমস্তু”
বেশ খানিকক্ষণ পরে যখন সজ্ঞানে ফিরলেন গঙ্গাজল সইয়ের ডাকে,উৎকর্ণ চোখদুটি যেন সেই তরুণটিকেই খুঁজছিল। চারিদিকে আরও অনেক সাধু, কিন্তু চোখ চালিয়েও তাঁকে কোথাও দেখতে পেলেন না।তিনি কে ছিলেন?স্বয়ং মহাদেব!
তাঁর চারিদিকে তখন তাঁকে ঘিরে আছে পরিচিত জনেরা, ফেরার সময় হয়ে এলো যে…অগত্যা ফিরলেন। আরতি দেখা হলো না;অনেকের আফশোষ, কিন্তু বিরজার মন জুড়ে প্রাপ্তির পূর্ণতা;কান জুড়ে দেবদুর্লভ কন্ঠধ্বনি,“শুভমস্তু, শুভমস্তু”...
রাতের হারসিলের ছোট্ট কটেজে ফিরেও সে আবেশ কাটেনি। দাদা আদ্যোপান্ত প্রকৃতি প্রেমিক। তিনি সন্ধ্যার আড্ডায় গ্রামটির সৌন্দর্য, কবে কোন সাহেব গ্রামটিকে উত্তর ভারতের সবচাইতে সুন্দর গ্রামের অভিধা দিয়েছিলেন,তার গল্প করছিলেন,বিরজা কিন্তু আনমনাই ছিলেন।
এমনকি, রাতের খাওয়া শেষে, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, নিশিকুহকী জ্যোৎস্নার মায়া হরিণেরা যখন একা একা সেই কটেজের হাতায় এসে ছুটোছুটি করে অবিন্যস্ত সুখে, তিনি এসে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই আলোকময় আচ্ছন্নতার মাঝে। বারংবার মনে হচ্ছিল, স্বয়ং দেবাদিদেবই কি এসেছিলেন মানবরূপে তাঁর দান গ্রহণ করতে! সামান্য জীবনতানে অসামান্য সুরের আবেশখানি জড়িয়ে দিতে!
তাই হয়তো কেউ বলেননি,নিষেধও করেননি। তবু স্বেচ্ছাধীন আপন ব্রতেই প্রিয়তম ফলটির স্বাদ গ্রহণ করেননি আর বাকী জীবন জুড়ে। যে ফল আপন হস্তে অর্পণ করেছেন দেবতাকে,সে ফল স্বতোৎসর্গী হোক।
শুধু বছরের পরে বছর সুতীব্র বৈশাখের দারুণ দহন কালে বাড়ির উঠোন জুড়ে টুপটাপ ঝরে পড়ে যখন দেবভোগ্য হিমসাগরের সুমিষ্ট ফলগুলি, দেবদারু গাছ ছোঁওয়া কবেকার হিমেল বাতাস আজও বয়ে যায় মনপ্রাণ জুড়ে, কে যেন এসে ফলভিক্ষে চায়;দূরে সরে যায় পরিচিত পরিবেশ, দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন দাদা, পিসিমা, সই-সইয়ের বর বা আপন গৃহের দাদা-বৌদিদি-ভাইপোরা; মনপ্রাণ জুড়ে বাজে শুধু… “শুভমস্তু… শুভমস্তু “
অসংলগ্ন ইচ্ছেগুলো জানে
অতীন্দ্রিয় উড়ালবেলা বিহঙ্গের সুখ
সন্ধ্যে জানে কায়াহীন সে নয়নতারা ফোটা
দৃষ্টিমুখর বাসনাদীপ প্রতীক্ষা উন্মুখ
যে চেয়ে থাকা অন্তহীন, অন্তর্লীন যে ইচ্ছে নিষুপ্ত নির্বাক, যে ভালোবাসা পথ ভুলেছে সেই কোন অপভ্রংশ বিহানবেলায়, জীবনের ঘাটে-অঘাটে তাই কি সে ফিরে ফিরে আসে ইমন কল্যানময় নির্বিকল্প শুদ্ধ আবাহনে! কে জানে!
0 Comments