জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬০ /বিজন সাহা

মাছ ধরে দেখাচ্ছেন ফার্মের মালিক সেরগেই রভুশকিন

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬০ 

বিজন সাহা 

পদ্ম আর মাছের সন্ধানে 


পরের দিন সকালে তুষারের সাথে আমরা রওনা হলাম কাস্পিয়ান সাগরে মাছ আর পদ্মের খোঁজে। আসলে আমার উদ্দেশ্য পদ্ম পুকুর, দিলীপের মাছের খামার – সেটা যতটা না মাছ কিনতে তার চেয়ে বেশি সেখানকার লোকদের সাথে কথা বলতে। তুষার বলল যে সেখানকার এক মৎস্য খামারের মালিক ওর বন্ধু। তাই সেদিকেই যাওয়া। আমি বসলাম তুষারের বুলেট প্রুফ গাড়িতে, দিলীপ দেমিদের সাথে। আমি আর তুষার পুরানো দিনের গল্প করতে করতে যাচ্ছি, শুনছি ওর আমেরিকার গল্প। এখানে বিয়ে ককরে থেকে যাওয়া, ব্যবসা বাণিজ্য এসবের কথাও ও বলছে। কথার মাঝে ঢুকে যাচ্ছে আমাদের ছাত্রজীবনের বন্ধুরা – বিমল, সুভাষ সহ অনেকেই। তুষার জানালো ওর আমেরিকার দিনগুলোর কথা।

তোকে তো বলা হয়নি, আমি কিন্তু আমেরিকায় মাইগ্রেট করেছিলাম। সুভাষের সাথে থাকতাম।
তা চলে এলি কেন?
আসলে একদিন বাইরে বেড়াতে গেছি। হঠাৎ একটু চাপ অনুভব করলাম। গেলাম কাছের এক সুপার মার্কেটে। ওখানে ম্যাকডনাল্ডস-এ ঢুকে ফ্রেশ হতে যাব, বলল আগে কিছু একটা কিনতে হবে। আমি ওদের অনেক বোঝালাম যে ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি যা নেবার। কিছুতেই ঢুকতে দিল না। আর সেখানে বেশ ভিড়। এই যে মন উঠে গেল, কিছু দিন পরেই রাশিয়া ফিরে এলাম।

আস্ত্রাখানের বাঙ্গি


এগুলো হয়তো কমন কোন ঘটনা নয়, তারপরেও অনেকের মনে সারা জীবনের জন্য দাগ কেটে দিতে পারে। গল্পে গল্পে ইতিমধ্যে শহর থেকে বেরিয়ে স্তেপ এলাকায় চলে এসেছি। হঠাৎ তুষার বলল 

দেমিদের গাড়ি দেখতে পাচ্ছি না। তুই একটু ফোন করে দেখ তো।

দেখলাম দিলীপ আর দেমিদের প্রচুর মিস কল। ফোন করে জানলাম ওরাও আমাদের হারিয়ে ফেলেছে। আসলে দেমিদ বুঝতে পারে যে গাড়িতে তেল ভরা দরকার। তাই আমাদের ফোন করে। তবে আমরা গল্পে এতই মত্ত ছিলাম যে কিছুই শুনতে পাইনি। তুষার দেমিদকে জানালো কিভাবে আসতে হবে। একসময় ওদের গাড়ি দেখা গেল। আমরা আবার পথে নামলাম। অনেকক্ষণ চলার পরে এলাম এক মৎস্য খামারে। বেশ বড় এলাকা নিয়ে তৈরি। কিছু দিন আগেই আমি দুবনার পাশে কানাকোভা গেছিলাম মৎস্য খামারে। সেটা অবশ্য এক্সপেরিমেন্টাল। সেখানে বিভিন্ন মাছ চাষ করে ভোলগায় ছেড়ে দেয়। এখানে ওরা মাছ চাষ ও শিকার দুটোই করে বিক্রির জন্য। এখানে মাছের বিভিন্ন জিনিস পাওয়া যায়। ভোলগায় বিভিন্ন বেসিনে বিভিন্ন সাইজের ও বিভিন্ন রকমের মাছ। কেনাও যায়। তবে তুষারের বন্ধু তখন ব্যস্ত ছিলেন। বললেন কয়েক ঘন্টা পরে আসতে। তাই আমরা চললাম পাশেই ঘোরাফেরা করতে। ইতিমধ্যে দেখালাম এক ছেলে সেখানে তরমুজ আর বাঙ্গি বিক্রি করছে। ওর কাছ থেকে খামারের মালিকের নম্বর নিয়ে ফোন করে বললাম দেখা করতে চাই। ও আমাদের খামারে যেতে বলল। বেশ কিছুক্ষণ ড্রাইভ করে আমরা খামারে উপস্থিত হয়ে জানালাম। ওদিক থেকে বলল আপনারা ওখানে ঘুরে দেখেতে পারেন, ছবি তুলতে পারেন, এমনকি তরমুজ বাঙ্গিও নিতে পারেন। আমরা ব্যস্ত কাজে। দুঃখিত। কী আর করা? আমরা সেখানে কিছু তরমুজ, বাঙ্গি ও অন্যান্য সব্জির ছবি তুললাম। মনে পড়ে গেল বাড়ির কথা। আমাদের বাড়ির সাথে পালানে এসব চাষ হত, তবে শুধুই নিজেদের জন্য, এমন বিশাল এলাকা জুড়ে নয়। ফিরে এসে সেই ছেলের কাছ থেকে কয়েকটা তরমুজ আর বাঙ্গি কিনে আমরা রওনা হলাম পদ্ম পুকুরের দিকে। 

এক সময় রাস্তাও শেষ হয়ে গেল। এখন মেঠো পথে যেতে হবে। কিছুক্ষণ পরে তুষার বলল ওর এক জরুরি মিটিং আছে, যেতে হবে। ও চলে গেল শহরে। আমরা সামনের দিকে। উঁচু নীচু মেঠো রাস্তায় অনেকক্ষণ ড্রাইভ করে শেষ পর্যন্ত চলে এলাম সেই জায়গায় যেখান থেকে নৌকায় করে পদ্ম দেখাতে নিয়ে যায়। তখন ওদের লাঞ্চ টাইম। আমরাও দুপুরের খাওয়া শেষ করে নিলাম। নৌকা ভ্রমণ মোটেই সস্তা নয়, জনপ্রতি পাঁচ হাজার করে। দেমিদ যাবে না বলল। আমি আর দিলীপ যাব। অনেকক্ষণ বসে থাকার পরেও গাইডের দেখা নেই। তার উপর বলল সেটা সীমান্ত এলাকা। ডকুমেন্ট চেক করতে পারে। এদিকে মাছের খামারের ভদ্রলোকের সাথে ইন্টার্ভিউয়ের সময় ঠিক করা। দিলীপ ফিরে যেতে চাইছে। ওরাও বলল এখন মৌসুম শেষের পথে। অনেক দূর যেতে হবে। সব মিলিয়ে পদ্ম দেখা বাদ দিয়ে ফিরে আসাই ঠিক হল। 

🍂

আমরা যখন মৎস্য খামারে এসে পৌঁছুলাম সেখানকার মালিক আমাদের অপেক্ষা করছিলেন। ছবি তোলার জন্য তিনি নিজে কয়েকটি মাছ ধরে দেখালেন। এরপর ছিল সাক্ষাৎকার পর্ব। দিলীপ প্রশ্ন করছিল, আমি সেটাকে অনুবাদ করে ওনাকে জানাচ্ছিলাম। ভদ্রলোকের নাম সেরগেই রভুশকিন। ৪৮ বছর বয়সী এই ভদ্রলোক পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আগে নিজের কনস্ট্রাকশন ফার্ম ছিল, কিন্তু প্রকৃতির মাঝে বাস করার ইচ্ছা নিয়ে ফিশারি শুরু করেন। আস্ত্রাখানের এই ভদ্রলোক শীতকালটা শহরে কাটালেও মাছের মৌসুম খামারেই কাটান। শুরু করেছেন বছর ১১ আগে। প্রথম ১০ বছর শুধুই পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। এখন মূলত সেই পুঁজি ফেরত পাচ্ছেন। আশা করছেন অচিরেই পাল্লাটা লাভের দিকে ঝুঁকবে। ইতিমধ্যে প্রতি বছর দেড় টন ক্যাভিয়ার আর ৬০ টন মাছ পাচ্ছেন। এখানে তার ৫০ টি সাচক বা ঘের, অন্য আরেকটা ফার্মে ২০০ মত। এখানেই তারা সেই ডিম থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে বড় মাছ পর্যন্ত সমস্ত স্তর পার করেন। ছোট ছোট টবে ডিম থেকে পোনা বের করা হয়। একেকটি টবে একেক ধরণের মাছ আর সবই  এক বয়সী। এদের খামারে চার ধরণের মাছ – অসেতর বা স্টার্জন, স্তেরলি বা স্টারলিং, সেভেরিউগা বা স্টেলেট স্টার্জন এবং বেলুগা। এই বেলুগা দেখতে ছোটখাটো এক হাঙ্গরের মত। দিলীপের এক প্রশ্নের উত্তরে জানালেন যে ক্যাভিয়ারের ব্যবহার সেই আদি কাল থেকেই। অন্তত জারদের আমল থেকে তো বটেই। সোভিয়েত আমলে এসবই ছিল সরকারি। নব্বই দশক থেকে প্রাইভেট বিজনেস শুরু হয়। এক সময় স্টার্জন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে এর শিকার নিষিদ্ধ করা হয়, তবে কৃত্রিম ভাবে চাষাবাদ শুরু হলে সবাইকে আবার লাইসেন্স ফিরিয়ে দেয়া হয়। ৪ মেয়ে ও এক ছেলের পিতা সেরগেইয়ের মেয়ে ফিশারির উপর পড়াশুনা শেষ করে বাবার ফার্মে কাজ করে। অন্যেরা কি করবে জানে না। এটা ওদের পারিবারিক ব্যবসা নয়। আসলে সোভিয়েত আমলে পারিবারিক ব্যবসা বলে কিছুই ছিল না। সেরগেই তিন ধরণের ব্যবসার সাথে জড়িত – ফিশারি, হোটেল আর পর্যটন। মাছ ও ক্যাভিয়ার সাধারণত হোটেলে সাপ্লাই দেয় – আস্ত্রাখানে, মস্কোয় আর সাঙ্কত পিতেরবুরগে। অনেকেই প্রতি বছর ওদের কাছে আসে মাছের জন্য। বেলুগার         ক্যাভিয়ারের দাম সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে বেলুগা যদি আলবিনোস হয় আর ক্যাভিয়ারের রঙ হয় সোনালী – তার প্রতি কেজি এক লাখ ডলার পর্যন্ত হয়। এখানে ভোলগার যে শাখায় তাদের ফার্ম তার নাম কিজান। খামারের মাছের খাবার মূলত আর্টিফিশিয়াল, তবে ছোট মাছও খেতে দেন।

রাস্তার ধারে ভূতের বাড়ি

সেরগেইয়ের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার শেষে আমরা ফিরলাম শহরে। এটাই আমাদের শেষ দিন। এর আগে ইন্ডিয়া ট্রেডিং কম্পাউন্ড সম্পর্কে যে বলেছিলাম সেটা দেখেছিলাম ওখান থেকে ফিরেই। সন্ধ্যায় বসে আছি। তুষারের ফোন

আমি তোদের পাশের সুপার মার্কেটে, চলে আয়। রাতে আমার বাসায় খাবি।

আমি দিলীপ আর দেমিদকে বলে বেরুব, আবার ফোন

দিলীপ বাবুকেও সাথে নিয়ে আয়।

এর কারণ দেমিদের নিরামিষ খাওয়া। দুবনায় ইন্ডিয়া থেকে কেউ এলে তারা যদি নিরামিষাশী হন, আমি নিজেও তাদের বাসায় ডাকতে ইতস্তত করি। আমরা দুজনে গেলাম তুষারের বাসায়। নদীর ওপাড়ে। আস্ত্রাখানের পশ এলাকায়। তুষার গাড়িতে করেই এলাকা একটু ঘুরিয়ে দেখাল। আস্ত্রাখানের মেয়র থেকে শুরু করে বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ কর্মচারী আর ব্যাবসায়ীদের আবাসিক এলাকা এটা। ঘরবাড়ির চেহারা চরিত্র দেখলেই বোঝা যায় জনগণের সেবকরা কতটা জনবিচ্ছিন্ন, কতটা অচ্ছুৎ। বড় বড় আমলারা নিজেদের জনগণের দাস বলে দাবি করে আর এ কারণেই মনে হয় শহর থেকে দূরে লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করে যেমন করত শুদ্র বা দলিত শ্রেণীর মানুষ। তুষারের বাসার নির্মাণকাজ চলছে। বাড়ির সামনে বাগান, সেখানে বিভিন্ন রকম গাছ। ওর স্ত্রী একটু অসুস্থ্য ও করোনা ভয়ে ভীত, তাই নীচে নেমে আমাদের সাথে দেখা করে চলে গেলেন। আমরা তিন জনে বাঙালি খাবার খেলাম। মাছ, মাংস ইত্যাদি। ভাগ্যিস দেমিদ আসেনি, তাহলে সমস্যাই হত। গল্প গুজবের পর ও আমাদের বাসায় পৌঁছে দিল। আমরা ওর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। কাল সকালে যাত্রা করব মস্কোর উদ্দেশ্যে। এর পড়ে তুষারের সাথে আমার দেখা হয়নি। আস্ত্রাখান থেকে ফেরার বছর দেড়েক পরে হঠাৎ ফোন করল।
মস্কো এসেছিলাম। এখন ফিরে যাচ্ছি। অনেকদিন আগেই লেটেস্ট মডেলের মার্সিডিজ কেনার ইচ্ছা ছিল। করোনার জন্য এত দিন হয়ে ওঠেনি। এখন সেই নতুন গাড়িতে করেই ফিরে যাচ্ছি। 
মাত্র কয়েক দিন আগে আবার লিখেছিল তুষার পর্বের পর। জানালো, যে বিল্ডিংএর সামনে ছাত্রদের ছবি তুলেছিলাম সেটা নিলামে কিনেছে। ছবি পাঠিয়েছে। বন্ধুদের উন্নতির খাবার শুনলে খুব ভালো লাগে এই ভেবে যে অন্তত একজন বন্ধুর ভালোমন্দ নিয়ে আমাকে চিন্তা করতে হবে না। 

মাছের বাড়ি
https://www.youtube.com/watch?v=XLj0uh8oMDc&t=32s

মাছের খোঁজে 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=265

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments