পর্ব-২০
স্বপন কুমার দে
প্রতিদিন যেমন অফিস যায়, আজও ঠিক তেমনই অফিস গেল সম্পূরক। গিয়ে দু'খানা চিঠি লিখল। একখানা তার অফিসের বড়সাহেবকে আর একখানা চিঠি স্ক্যান করে হেড অফিসে মেল করে দিল। ট্রান্সফারের জন্য আবেদন। এতদিন চেপে চেপে রেখেছিল, নইলে কবেই ট্রান্সফার হয়ে যেত। আজ নিজে থেকেই ট্রান্সফার চাইল।
বড়সাহেব অ্যাপ্লিকেশন লেটারটা পড়ে কতক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর খুব শান্তভাবে বললেন," ঠিক আছে, আমি হেড অফিসে জানিয়ে দেব।" সম্পূরক সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে, হঠাৎ পিছন থেকে একটা দরদ মাখানো ডাক ভেসে এল,' সম্পূরক!"
সম্পূরক পিছন ফিরল। বড়সাহেব বললেন,' বোসো।'
সম্পূরক অবাক হয়ে চেয়ে আছে তাঁর দিকে। বড়সাহেব অফিসের বস হলেও কোনোদিন তাকে 'তুমি' সম্বোধন করেননি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে পড়ল চেয়ারে।
" সম্পূরক, আমরা কেউই জানিনা আগামীকাল কী হবে, অথচ,তার জন্য আমরা কত প্ল্যান করি, হিসাব কষি, স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সব সময় হিসাব মেলে না, স্বপ্ন ভেঙে যায় । আমরা দিশাহারা হয়ে পড়ি। কিন্তু, তাই বলে কি স্বপ্ন দেখবো না? এটাই তো মানুষের জীবন। স্বপ্ন দেখতে হবে। ভরসা হারালে চলবে না।পাখিদের দেখেছো? ঝড় ঝাপটায় তাদের ঘর ভেঙে যায়। আবার তারা ঠোঁটে করে একটি একটি খড় কুটো বয়ে নিয়ে আসে, বাসা তৈরি করে। আমরা তো মানুষ। অনেক কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের আছে। আজ যেটা তোমার সঙ্গে হয়েছে, সেটাই শেষ কথা নয়। সেটা হয়তো হিসেবে ভুল ছিল, তাই অংক মিলল না। এটাও জীবনের শিক্ষা। মানুষের জীবন তো অসংখ্য সত্য মিথ্যার সংকলন। তাই যেখানেই যাও, মাথা উঁচু করে যাও। পিছন ফিরে তাকিও না।"
প্রত্যুত্তরে সম্পূরক বড়সাহেবের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে মাথাটা দু'বার উপর নীচ করলো। রুম থেকে বেরিয়ে এল সম্পূরক।
🍂
আরও পড়ুন 👇
সন্ধ্যার টিফিন খাওয়া হয়ে গেলে বড়দের চায়ের আসর বসেছে। মন্টির ইংরেজি স্যার এসেছেন, মন্টি সেখানে পড়ায় ব্যস্ত। আজ উদ্দালকও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে। বাবা, মা, উদ্দালক, বৌদি আর সম্পূরক নানান আলোচনায় যে যার মতামত রাখছে। চা খেতে খেতে এরকম কথাবার্তায় অনেক কিছু বিষয়েই উঠে আসে। এরই মধ্যে সম্পূরকের মায়ের গোঁতা খেয়ে বাবা সজাগ হয়ে উঠলেন। বললেন," সমু, দালু, তোমরা সবাই শোনো। আমি একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই।" সবাই প্রাথমিকভাবে চুপচাপ হয়ে বাবার কথায় মন দিল। অমরেশবাবু কিছু ভূমিকা না করেই বলতে শুরু করলেন," সমু! এবার তো আমাদের তোদের বিয়ের কথা ভাবতে হবে। আমার আর তোর মায়ের বয়স হচ্ছে। এখন তাহলে রূপসার বাবা-মা'র সঙ্গে কথা বলি ।তারপর একটা দিন দেখে...."" না বাবা, বলার দরকার নেই। " সম্পূরক মৃদুভাবে বলল।
মা এবার ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, " কেন, দরকার নেই কেন? বারে বারে শুধু আপত্তি। পরে আর পরে। আমরা আর কতদিন অপেক্ষা করবো? এবার তোর ভালোমন্দের দায়িত্ব নেওয়ার লোকের দরকার।"
সম্পূরকের মুখ চোখ পাংশুটে হয়ে গেছে। মানসিক যন্ত্রণা ঢাকা দিতে সে দু'দিন বাড়িতে হাসিখুশি থাকার অভিনয় করে গেছে এতক্ষণে তা ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। তথাপি তাকে দৃঢ় হতে হবে। তাই শুকনো মুখে মৃদুভাবে বলল," মা, রূপসার অন্য জায়গায় বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে।"
যদি সেই মুহূর্তে সেখানে হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণ হত, তাহলেও বোধহয় এতটা অবাক হত না। একটা শান্ত, হাসিখুশি পরিবেশ চোখের পলকে কিভাবে আমূল বদলে যেতে পারে তা দেখল এই বাড়ির লোকজন। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলে হতভম্ব হয়ে গেল।
" তার মানে?" চিৎকার করে উঠল মা," এ কি ছেলেখেলা পেয়েছে নাকি? এতদিন ধরে ঘুরল, স্বপ্ন দেখাল, তারপর ইচ্ছা মতো সেই সম্পর্ককে ভেঙে দিল। রূপসা ভেবেছেটা কী? আমার ছেলেকে ঠকানো! ওর নাম্বারটা আমাকে দে। আজ ওর একদিন কি আমার একদিন।" অমরেশবাবু স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বলেন," আঃ মণি, একটু চুপ করো। ব্যাপারটা আমাকে বুঝতে দাও।" উদ্দালক ও তার স্ত্রী বাবাকে সাপোর্ট করে।
বাবা বলেন, " সমু, তুই যা বললি তা কি ঠিক? রাগের মাথায় মিথ্যে দোষারোপ করছিস না তো?"
" না বাবা, একদম ঠিক খবর।"
" তুই কী করে জানলি? কার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে?"
" বিয়ে হচ্ছে আমাদেরই অফিসের ছোটসাহেব অসীম দাশগুপ্তের সঙ্গে। গতকাল টিফিনের সময় এই খবরটা অসীমবাবুই আমাদের দেন এবং বিয়ে বাড়িতে যাবার নিমন্ত্রণ করেন।"
বাবা আরও গম্ভীর হলেন। একটু সময় নিয়ে বললেন, " হঠাৎ রূপসার এরকম সিদ্ধান্ত বদল? এতদিন তো তোর সঙ্গেই ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল, তাহলে আজ এতবড় কান্ড? আমার তো মাথায় ঢুকছে না। তুই কি ওর সাথে কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করেছিলি?"
সম্পূরকের গলা ধরে আসছে তবুও কষ্ট করে, গলা ঝেড়ে বাবার কথার উত্তর দিয়ে গেল, " না বাবা। ঝগড়া তো দূরের কথা, অসীমবাবু আসার পর থেকে আমরা একসঙ্গে কোনওদিন বেরোই না।"
" তাহলে কারণটা কী?"
" ওরা দুজনে ছোটবেলার বন্ধু। ওদের নাকি ফ্যামিলি রিলেশন আছে।"
" তাহলে এতদিন ধরে তোকে ঘোরালো কেন?"
মা এবার জোরের সঙ্গে বলতে লাগলেন, " এতবড় অপমান! আমাকে ওর ফোন নাম্বারটা দে। আমার ছেলে ওর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে, আমি জিজ্ঞেস করবো, আমার ছেলের এতবড় ক্ষতি করতে তার বাধল না?"
বাবা বলেন," মণি শান্ত হও। এটা সমুর পক্ষে ভালোই হয়েছে। এটা যদি আরও পরে হত,অর্থাৎ ওদের বিয়ের পরে হত তখন আমাদের অবস্থাটা কী হত ভেবে দেখেছো? এতে বরং সমু বেঁচে গেছে, আমাদের সম্মানও বেঁচে গেল। আজকের মন্দটা সমুর ভবিষ্যতের জন্য ভালো। এখন আমার চিন্তা হচ্ছে যে, একই অফিসে সমু চাকরি করবে কীভাবে? মানুষের মন তো, প্রতিদিনের যন্ত্রণা বয়ে বয়ে ও কীভাবে টিকে থাকবে?"
" বাবা, আমি ট্রান্সফারের জন্য অ্যাপ্লাই করেছি, খুব শিগগিরই হয়ে যাবে। এতদিন আমিই ট্রান্সফার আটকে আটকে রেখেছিলাম, এবার আর কোনো বাধা নেই।" সমু ধীরে ধীরে উত্তর দেয়।
দাদা উদ্দালক বলে," এইভাবে হেরে যাওয়া তো ঠিক নয়। ওদের ভয়ে নিজে পালিয়ে বেড়াবি?"
বাবা বললেন," এটা পালিয়ে যাওয়া নয় বরং পরের লড়াইয়ের জন্য নিজেকে শক্ত করা। ওই অফিসে থেকে ওটা সম্ভব নয়।"
বৌদি বলল," তোমার এই লড়াইয়ে আমরা তোমার পাশে আছি। দেখে নিও, এমন একদিন আসবে যেদিন তোমার সুখ দেখে ওরা হিংসায় জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে।"
অমরেশবাবুর কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখা, মণিদীপার মাথায় অপমানের আগুন, উদ্দালক-সুদেষ্ণার বিস্ময়-বিহ্বল ভাব সে বাড়ির আলোগুলোকে রাতে অনেকক্ষণ জ্বালিয়ে রেখেছিল। সম্পূরক বুঝতে পেরেছিল, এ অপমান, যন্ত্রণা তার একার নয়, গোটা পরিবারের। তথাপি, এ যন্ত্রণাকে চেপে রেখে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার প্রতিজ্ঞা করল।
0 Comments