নবম পর্ব
প্রসূন কাঞ্জিলাল
রাজা মুচুকুন্দ
হিন্দু পুরাণে বর্ণিত সূর্য রাজবংশের একজন রাজা হলেন এই রাজা মুচুকুন্দ । তিনি রাজা মান্ধাত্রের পুত্র এবং যার সহোদর অম্বরীষ ও পুরুকুৎস (ভাই) এবং যার ১৫ জন বোনও ছিলো।
ভাগবত পুরাণ অনুসারে, দেবতারা একবার অসুরদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। তারা মুচুকুন্দ রাজার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন , যিনি একজন মহান যোদ্ধা এবং একজন ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই বীর রাজা মুচুকুন্দ দেবতাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন যতক্ষণ না তারা শিবের পুত্র কার্তিকের অধীনে নিজেদের সমাবেশ করে। তাদের বিজয়ের পর, দেবতারা এবং দেবরাজ ইন্দ্র তাকে সবিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং পৃথিবীতে বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থান উৎসর্গ করার জন্য রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। দেবতারা তাকে অবগত করেন যে এই যুদ্ধ চলাকালীন ত্রেতাযুগ এখন দ্বাপর যুগে রূপান্তরিত হয়েছে এবং তার পরিবারের সবাই মারাও গেছেন । দেবতাগন রাজা মুচুকুন্দকে মোক্ষ (মুক্তি) ব্যতীত তার ইচ্ছে মতো পছন্দের কোনও বর চেয়ে নিতে অনুরোধ করেন , কারণ এটি অর্থাৎ মোক্ষ তাদের বরদান-সামর্থ্যের বাইরে ছিল। কিন্তু তার পরিবার আর বেঁচে নেই জানতে পেরে রাজা মুচুকুন্দ শোকে স্তব্ধ হয়েছিলেন এবং সমস্ত যুদ্ধের পরে ক্লান্ত বোধ করছিলেন , তিনি দেবতাদের কাছে নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের আশীর্বাদ চেয়েছিলেন তখন,এই বিধান দিয়ে যে কেউ ওনাকে বিরক্ত করার সাহস করবে, সে ই অবিলম্বে ছাই হয়ে যাবে।
দেবতারা এই বর তাকে দিয়েছিলেন এবং রাজা মুচুকুন্দ এক গুহায় তার ঘুম শুরু করেছিলেন।
তারপরে মুচুকুন্দ রাজার নিরবিচ্ছিন্ন ঘুমের এই আশীর্বাদ ; দুষ্ট রাজা কালযবনের মৃত্যুর কারণ হয়ে যায় যা রাজা কালযবনের চরিতালোচনায় বিশদে ব্যাখ্যা করা রয়েছে।
ওই গুহায় ওই সময় উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, যার পরামর্শে রাজা মুচুকুন্দ গন্ধমদন পর্বতে এবং সেখান থেকে তপস্যা করার জন্য বদ্রিকা আশ্রমে যান।
এই কাহিনীটি যুগ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। রাজা মুচুকুন্দ গুহায় বিশ্রাম নেওয়ার সময়, কালের সাথে সাথে সমস্ত প্রাণীর আকার এত সংকুচিত হয়ে গেছে দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
কালযবন
মহাভারতে বর্ণিত একজন রাজা ছিলেন কালযবন । তিনি কৃষ্ণের বিরুদ্ধে প্রায় তিন কোটি যবন (বর্বর) সৈন্য নিয়ে মথুরা আক্রমণ করেছিলেন বলে কথিত আছে। ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে কালযবনের জন্মের একটি গল্প বর্ণিত আছে, তা হলো বৃকাদেবী নামে একজন মহিলা গর্গ্য (গর্গের বংশধর) এর পুরুষত্ব পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। গর্গ্য বীর্যপাত করতে অক্ষম ছিলেন , যার জন্য যাদবরা তাকে অপমান করেছিল। বারো বছরের তপস্যার পর, গর্গ্য মহাদেবের কাছ থেকে বর পেয়েছিলেন যে তিনি এক পুত্র পাবেন যে যাদবদের ধ্বংস করবে। তার তপস্যার সময়, তিনি লোহার টুকরো খেয়েছিলেন যা তার বর্ণকে লোহার মতো কালো করে তোলে।
পরবর্তীকালে, গর্গ্য মথুরায় আসেন এবং রাম্ব নামক এক গোপালক কন্যার (গোপী) সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন, যিনি আসলে ছদ্মবেশে একজন অপ্সরা ছিলেন। কালযবন এই মিলনের ফল হিসেবে জন্মেছিলেন । গর্গ্য তাকে নতুন রাজা হিসাবে মুকুট পরিয়েছিলেন এবং তারপর বনে চলে যান।
আবার বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশ অনুসারে, কালযবন ছিলেন একজন যবন রাজা। তিনি ছিলেন ক্রোধের আংশিক অবতার।
জরাসন্ধ, কংসের শ্বশুর এবং মগধের শাসক সতেরো বার মথুরা আক্রমণ করেছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই কৃষ্ণের দ্বারা পরাজিত হয়েছিলেন । জরাসন্ধ, নিজে থেকে কৃষ্ণকে পরাজিত করতে না পেরে কালযবনের সাথে মিত্রতা করেন। কালযবন একজন শক্তিশালী যবন যোদ্ধা হয়েছিলেন, যিনি শিবের কাছ থেকে বর পেয়েছিলেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি অপরাজেয় হবেন।
কৃষ্ণ, তার লোকদের রক্ষা করার জন্য, দ্বারকা নামে শক্তিশালী শহর তৈরি করেছিলেন, যেখানে তিনি মথুরার বাসিন্দাদের নিয়ে যেতেন। কালযবন তিন কোটি যবনের বাহিনী নিয়ে মথুরা আক্রমণ করেন। কৃষ্ণ, বুঝতে পেরেছিলেন যে যবনরা সমস্ত যাদবদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাই চতুরতা করে তিনি কালযবনকে দ্বন্দ্বের জন্য আহবান করার সিদ্ধান্ত নেন। কৃষ্ণ কৌশলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। কৃষ্ণ কালযবনকে সেই গুহায় প্রলুব্ধ করেছিলেন যেখানে ত্রেতাযুগের মহান রাজা মুচুকুন্দ ( রামের পূর্বপুরুষদের একজন ) নিদ্রারত ছিলেন।অসুরদের সাথে মহাকাব্যিক যুদ্ধে দেবতাদের সাহায্য করার পর দেবতাদের বরে এবং পরিবারের সকলকে হারিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে তিনি নিরবিচ্ছিন্ন গভীর নিদ্রায় ছিলেন এবং একেবারে নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের আকাঙ্ক্ষা করে, তাকে ইন্দ্র একটি বর দিয়েছিলেন যে যে কেউ তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে সাহস করবে সে অবিলম্বে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
দ্বাপরযুগে, গুহার গভীরে অন্ধকারে, কৃষ্ণ তার উত্তরীয় দিয়ে ঘুমন্ত মুচুকুন্দকে ঢেকে দিয়ে ছিলেন এবং আড়ালে চলে গিয়ে ছিলেন।কালযবন,ঘুমন্ত মুচুকুন্দকে কৃষ্ণ বলে ধরে নিয়ে তাকে পদাঘাত করেছিলেন , এইভাবে রাজার ঘুম ভেঙে যায় এবং ইন্দ্রের বরের ফলস্বরূপ কালযবন ভস্ম হয়ে যায়। এরপরই সেই গুহায় কৃষ্ণকে দেখে মুচুকুন্দ আনন্দিত হলেন। তার পুঞ্জীভূত পাপ শুদ্ধ করার জন্য এবং মোক্ষ লাভের জন্য কৃষ্ণ তাকে তপস্যা করার উপদেশ দিয়েছিলেন। সেই উপদেশ মতো দেবতাদের সঙ্গে দেখা করে মুচুকুন্দ গুহা থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তপস্যা করার জন্য মুচুকুন্দ তারপর উত্তরে গন্ধমদন পর্বত এবং সেখান থেকে বদ্রীকাশ্রমে যান এবং অবশেষে মোক্ষ আকারে মুক্তি লাভ করেন।
1 Comments
ধন্যবাদ
ReplyDelete