প্রথম পর্ব
প্রসূন কাঞ্জিলাল
বিকর্ণ
মহাভারতের একটি ছোট কিন্তু নজরকাড়া চরিত্র ইনি। ব্যাসদেবের আশীর্বাদে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর যে শতপুত্র জন্মগ্রহণ করে তাদের মধ্যে সবথেকে ধার্মিক ছিলেন বিকর্ণ। দুর্যোধনের ভাই হলেও তিনি তাঁর বাকি ভাইদের মত বদমেজাজি ও অহংকারী ছিলেন না। পান্ডবদের পাশাখেলায় পরাজয়হেতু সভামধ্যে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের একমাত্র প্রতিবাদ করেছিলেন তিনিই। এর প্রতিবাদে এমনকি তিনি সেই সভাস্থল ত্যাগও করেন।
পরবর্তীতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও তিনি কৌরব পক্ষের হয়ে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেন। ভীম কৌরবদের একশ ভাইকে বধ করবার পণ নিয়ে যখন কুরুক্ষেত্রকে প্রায় শ্মশানে পরিণত করেছেন তখন বিকর্ণ তার সম্নুখে দাঁড়িয়ে দ্বন্দের আহ্বান জানান, ভীম কিছুকাল ভাবেন , তার সভার কথা মনে হতে তিনি বিকর্ণকে বলেন তুমি একমাত্র কৌরব যে জানে ধর্ম কি? তুমি সরে দাঁড়াও আমি তোমাকে বধ করতে চাই না। তুমি একমাত্র যে সেই সভায় দুর্যোধনের প্রতিবাদ করেছিলে।কিন্তু বিকর্ণ বলেন আজ আমার সরে যাওয়াটাও অধর্ম হবে, আমি জানি কৌরবদের এই যুদ্ধে জয়লাভ কোনোদিনিই হবে না যেহেতু বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ পান্ডব পক্ষে আছে, কিন্তু আমি আমার বাকি ভাই দের এবং জ্যেষ্ঠ ভাই দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করতে পারব না। আমি ধার্মিক কিন্তু বিভীষণ নই। আমাকে যুদ্ধ করতেই হবে। তিনি বীর বিক্রমে বলেছিলেন " সেই সভাস্হলে আমার যা কর্তব্য ছিল করেছি কিন্তু এখন আমার কর্তব্য আমার ভাইদের রক্ষা করা তাই এসো আমার সাথে দ্বন্দ্ব কর বৃকদর ভীম"। যুদ্ধে ভীমের হাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বর্বরিক
মহাভারতে বীর ও ধার্মিক বহু চরিত্র স্বল্পালোচিত, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হিড়িম্বা-পৌত্র বর্বরিক।
অর্জুন ছাড়া যে তিনজন প্রত্যক্ষভাবে কৃষ্ণের মুখ থেকে গীতা শুনেছিলেন, তারা হলেন, সঞ্জয় তিনি যুদ্ধের ঘটনা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করার জন্য বেদব্যাসের কাছ থেকে দিব্য দৃষ্টি লাভ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত হনুমান,তিনি অর্জুনের রথের চূড়ায় বসে ছিলেন এবং তৃতীয় জন ঘটোৎকচের পুত্র বর্বরিক তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সব ঘটনা দেখেছিলেন।
যে বীর বালক এক বানেই সম্পুর্ন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ করতে পারত, সেই পান্ডুপূত্র ভীমের পৌত্র, ঘটোৎকচের পুত্র বর্বরিকের সমন্ধে আলোকপাত করা যাক।
বর্বরিক ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অতি প্রিয় ভক্ত।
একবার কৃষ্ণ আর মুরা নামক এক অসুরদের রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ বাধল। যুদ্ধে ভগবান কৃষ্ণ অসুরের বধ করল। এ খবর শুনে দানবের কন্যা কামকালীকা যুদ্ধ করতে আসল। সে ছিল মা দূর্গার একনিষ্ঠ ভক্ত। সে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের ওপর মা দুর্গার দেওয়া যতো অস্ত্র ছিল সব প্রয়োগ করল, কিন্তু সব অস্ত্র শ্রী কৃষ্ণের কাছে এসে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল। তখন ভগবান শ্রী কৃষ্ণ অসুর কন্যার ধৃষ্টতা দেখে সুদর্শন চক্র দিয়ে কামকালীকাকে বধ করতে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই মা দূর্গা স্বয়ং প্রকট হয়ে ভগবানের কাছে কামকালীকাকে না বধ করার জন্য প্রার্থনা করলেন এবং কামকালিকাকে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের পরিচয় দিলো।
🍂
কামকালীকা তখন শ্রী কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা চাইলেন। ভগবান কৃষ্ণ তখন কামকালীকার যুদ্ধে প্রসন্ন হয়ে তার সঙ্গে ভীমের পূত্র ঘটোৎকচ এর বিবাহ ঠিক করল। ঘটোৎকচ এতে খুব খুশি হল। কিন্তু সে তার মাতা হিড়িম্বার আশির্বাদ নিয়ে বিয়ে করতে চাইলো।
হিড়িম্বা তখন এক পর্বতে বসে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের তপস্যা করছিলো। ভগবান তখন ঘটোৎকচ আর কামকালীকাকে নিয়ে হিড়িম্বার কাছে গেল এবং আদেশ দিলো ঘটোৎকচ আর কামকালীকার পুত্র বর্বরিককে ছেলেবেলা থেকেই ধর্মীয় কাহিনী শুনিয়ে ধার্মিক করে গড়ে তুলতে। হিড়িম্বা তাই করল।
বর্বরিক তারপর তার ঠাকুরমার কাছে মোক্ষ প্রাপ্তির সবচেয়ে সহজ উপায় জানতে চাইলো। হিড়িম্বা তখন বলল, যদি সে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের হাতে বধ হয়, তাহলে তার সঙ্গে সঙ্গে মোক্ষ লাভ হবে।
এ কথা শুনে বালক বলল, ‘তাহলে আমি ভগবান শ্রী কৃষ্ণের কাছে গিয়ে বলি যে, সে তার সুদর্শন চক্র দিয়ে আমার গলা কেটে দিক...’ এ কথা শুনে হিড়িম্বা হেসে বলল, ভগবান তাকে এমনিতে মারবে না। ভগবানের হাতে মরতে হলে তার সমকক্ষ যোদ্ধা হতে হবে।
এ কথা শুনে বর্বরিক মা দূর্গার কঠোর তপস্যা করল। মা দূর্গা তাকে তার নবরুপ অর্থাৎ নয়টি রূপ দেখালেন, সমস্ত অস্ত্র দিলেন। এতেও বর্বরিক সন্তুষ্ট হলো না। তখন মা দূর্গা তাকে বলল যে, ‘তুমি যে স্থানে বসে তপস্যা করেছ, সেই স্থান সিদ্ধ হয়ে গেছে। তাই তুমি এই স্থানে বসে সিদ্ধিমাতার উপাসনা করো। তোমাকে সিদ্ধিমাতা তোমার অভীষ্ট বর প্রদান করবেন।’
তখন সিদ্ধি মাতাকে সন্তুষ্ট করে তার কাছ থেকে বাসুদেব অস্ত্র সহ অনেক অস্ত্র লাভ করলেন। এই সব অস্ত্রের কারনে বর্বরিক অজেয় হলেন।এই সব কিছুর পিছনে বর্বরিক এর উদ্দেশ্য ছিল কৃষ্ণর হাতে মৃত্যু লাভ করা। কারন সে জানত তার কাছে যে অস্ত্র আছে তাতে কৃষ্ণ ব্যতিত ত্রিভুবনের কেও তাকে মারতে সক্ষম হবে না।
তাই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সে কৌরবদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য কুরুক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে রওনা হল। পথে কৃষ্ণ এক ব্রাহ্মনের বেশে তার পথ রুখে দাঁড়াল এবং জিঞ্জাসা করল, ‘হে বালক, তুমি কোথায় যাচ্ছ?’
বালক উত্তরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগদানের কথা বলল।
তখন ব্রাহ্মনরূপী কৃষ্ণ তাকে বলল, ‘কিন্তু তোমার সৈন্য কোথায়? মাত্র ৩টা বান নিয়ে এসেছ! আর তুমি কাদের পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করবে?’
তখন বালক বলল, ‘আমার কোনো সৈন্যের প্রয়োজন নেই। আমার এই তিন বানের এক বানেই আমি সম্পুর্ন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ করতে পারি। আর আমি কৌরবদের পক্ষে যোগদান করব। কারন, পান্ডবদের পক্ষে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ আছেন, তাই তারা শক্তিশালী আর কৌরব দূর্বল। তাই আমি কৌরবদের পক্ষে যেতে চায়। আর আমি আমার মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, সর্বদা দূর্বলের সাহায্য করব।’
তখন ব্রাহ্মনরূপী কৃষ্ণ বলল, ‘আচ্ছা, তাহলে পরীক্ষা দেও। এই বটগাছের সমস্ত পাতা ছেদ করে দেখাও।’ কিন্তু কৃষ্ণ কৌশলে ১টি পাতা হাতের মুঠোয় এবং ১টি পায়ের তলায় লুকিয়ে রাখে। বর্বরিক এক বানে গাছের সব পাতা ছেদ করে। এমনকি কৃষ্ণের লুকিয়ে রাখা দুটি পাতাও ছেদ হয়ে যায়। তখন বর্বরিককে উত্তেজিত করার জন্য কৃষ্ণ বলে যে, সে গাছের পাতা ছেদ করতে পারলেও পান্ডবদের বধ করতে পারবে না।
এ কথা শুনে বর্বরিক পান্ডবদের মারার জন্য ধণুর্বাণ মারতে উদ্ধত হলে কৃষ্ণ তার সুদর্শন চক্র দিয়ে বর্বরিকের মাথা কেটে ফেলে। এবং তার আসল রূপ ধারণ করে বর্বরিককে বলল, ‘আমি ব্রাহ্মণ বেশে তোমাকে পরীক্ষা করতে এসেছিলাম। কিন্তু তোমার আচরনের জন্য আমার তোমাকে বধ করতে হল।’
এ কথা শুনে বর্বরিক বলল, ‘হে ভগবান, আমি আপনাকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলাম। এবং আপনার হাতে মরার জন্যই এ রকম করছিলাম। হে প্রভু, আপনার কাছে আমি প্রার্থনা করি, আপনি আমার মাথাটাকে জীবিত রাখুন, যাতে আমি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আপনার লীলা দেখতে পারি।’ কৃষ্ণ তখন তথাস্তু বলে স্থান ত্যাগ করল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষও হল। পঞ্চপান্ডব আর শ্রী কৃষ্ণ এক সথে বসে যুদ্ধ নিয়ে আলাপ আলোচনা করছে।
পঞ্চপান্ডব নিজেরা নিজেদের পরাক্রমের বিষয়ে বলছিল আর তা নিয়ে প্রশংসা করছিল। এমন সময় বাইরে বর্বরিকের বলার অট্টহাসির শব্দ শোনা গেল। হাসি শুনে সকলে বাইরে বেরিয়ে এলো। পঞ্চপান্ডব তখন বর্বরিকের কাছে তার হাসির কারন জানতে চাইল।
বর্বরিক তার হাসির কারন বলতে গেলে কৃষ্ণ তাকে বাধা দিয়ে বলল, তুমি তোমার দিব্য দৃষ্টিতে যা দেখেছ, এরা চর্ম চক্ষুতে তা দেখতে পারেনি। তাই তুমি এদের কিছু বলনা।
কিন্তু বর্বরিক কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা চেয়ে পঞ্চপান্ডবকে বলল, ‘তোমরা যে তোমাদের পরাক্রম নিয়ে এত প্রশংসা করছ, কিন্তু আমিতো একজনকেও কোনো পরাক্রম দেখাতে পারলাম না। সুদর্শন চক্র ভীষ্মর দেহ ছিদ্র করছিল, আর অর্জুনের নিরর্থক বান গুলো সেই ছিদ্রের ভিতর দিয়ে ঢুকছিল........................................’ এভাবে সে সমস্ত যুদ্ধের বিবরন দিয়ে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন।অর্থাৎ বর্বরিকের মোক্ষপ্রাপ্ত হয়ে গেলো।
( ক্রমশ)
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
1 Comments
ধন্যবাদ
ReplyDelete