পর্ব ১৩
সৌমেন রায়
চিত্র – অসিত কুমার সেনাপতি
'মার্কসবাদ' (১)
মাঝে মাঝে একটা কথা শোনা যায় যে স্কুলে স্কুলে এত বিপুল আয়োজন ও সরকারি ব্যয় সত্ত্বেও টিউশন পড়তে হবে কেন ? আগের দুটি পর্ব পড়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কেন ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশন পড়তে হয়। আট দশ বছর আগেও ক্লাসে, অভিভাবক সভাতে মাথা উঁচু করে বলা যেত ঠিকমতো ক্লাস ফলো করলে টিউশন পড়ার দরকার নেই। এখন সেটি বলার মত গলার জোর নেই। মিনমিন করে বলতে হয় বাবা টিউশন পড়ছিস পড় স্কুলেও আয় । আমরাও তো পড়াই নাকি! অবশ্য এমন নয় যে গত দশ বছরেই টিউশনের জন্ম হয়েছে। টিউশনের প্রচলন প্রাচীন কাল থেকেই। এখন শুধুমাত্র ভরকেন্দ্রটা পাল্টে গেছে। এখন শিক্ষার ভরকেন্দ্র টিউশন। একটা কথা স্বীকার করতেই হবে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে টিউশন অপরিহার্য। কারণ সেখানে সময় কম, সিলেবাস বেশি। এখানে যাবতীয় আলোচনা মাধ্যমিক স্তরের টিউশন নিয়ে।
তা কেমন হয় টিউশন গুলি? গ্রামের টিউশন আর শহরের টিউশন আবার আলাদা। প্রথমে দেখি গ্রামের টিউশন। সেখানে যারা পড়ান তারা কেউ কেউ সর্ববিদ্যা বিশারদ। উপহাস করবেন না। এরা শিক্ষা জগতের হাতুড়ে ডাক্তারের মত। এরাই হাতের কাছে প্রথম সহায়। আগে এরা স্কুলের শিক্ষকদের ভুলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। একটু ভুলভাল হলেই লাফ দিয়ে স্কুলে এসে তর্ক করতেন। একবার এক ইংরেজি শিক্ষক বলছিলেন মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ভুল করি। সামান্য ভুলের বিনিময়ে অন্যকে আনন্দ দিয়ে সে যে কি আনন্দ! একমাত্র ভৌতবিজ্ঞানে এদের কোনদিন অভিযোগ ছিল না। কারণ বিষয়টা গোলমেলে। জলে তেল ভাসে আবার তেলেও জল ভাসে। এইসব শিক্ষকরা সিলেবাস পরিবর্তনের পর একটু দমে গেছেন। নতুন করে সবকিছু আয়ত্ত করা মুশকিল। এখন চল হয়েছে টোলের। একটা চালা ঘরে বিভিন্ন বিষয় শিক্ষক এসে পড়ান। সেখানে কি কি হয়? বিভিন্ন বিষয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী দ্বারা পড়ানো হয়। নিয়মিত পরীক্ষা হয়। পিছিয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ কোচিং দেওয়া হয়। উন্নত মানের নোট দেওয়া হয়। দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। এতসব হয়? না মানে আমি ব্যানার দেখে বলছি। আপনার বিশ্বাস না হয় পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ওটাও ব্যানারে লেখা আছে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়। এখানে পড়ায় কারা? মূলত কাজ না পাওয়া ছাত্রছাত্রীরা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জাত শিক্ষক। কিন্তু অধিকাংশই কিছু কাজ না পেয়ে শিক্ষক। একসাথে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জন বসে, তাও আবার বিভিন্ন ক্লাসের। অর্থাৎ স্কুলেরও বাড়া। ইন্ডিভিজুয়াল কেয়ারের প্রশ্নই নেই। এখন সব বিষয়ে টিউশন পড়তে হয়। না হলে পিছিয়ে পড়তে হয় বলে অভিভাবক মনে করেন। গ্রামের এক ভাড়া গাড়ি চালক নাইনে পড়া মেয়ের জন্য সব বিষয় মিলে সাতটা টিউশন দিয়েছেন। বলছেন গাড়ির কিস্তি আর মেয়ের টিউশনের টাকা দিতেই সব শেষ। ছেলেমেয়েরা ছুটছে আর ছুটছে। কেন ছুটছে , থলিতে কি জুটছে ভাবার অবকাশ নেই। এইসব জায়গায় আবার স্কুলকে হীন দৃষ্টিতে দেখানো হয়। স্কুল না যেতে উৎসাহিত করা হয়। স্কুল টাইমে পড়া দিয়ে দেওয়া হয় । ইচ্ছে করে দশটার পর ছাড়ে , যাতে স্কুল না যেতে পারে। হাঁপাতে হাঁপাতে কেউ কেউ আসে। কারো বা খাওয়া টুকু হয় না। গণিতের এক শিক্ষক একবার খুব ভালো করে সময় নিয়ে অনুপাত, সমানুপাত শেখালেন ক্লাস সেভেনে। ছাত্রছাত্রীরা ভালো রেসপন্স করতে লাগল। আহ্লাদে আটখানা হয়ে তিনি বানিয়ে একট অংক করতে দিলেন। দু-একজন ছাড়া কেউ পেন লাগাল না। অনেক খোঁচাখুঁচি পর একজন বলল স্যার এটা এখনো টিউশনে হয়নি। স্যার দুদিন ধরে গম্ভীর মুখে ভাবছিলেন যে তিনি তাহলে ক্লাসে কি করাচ্ছিলেন। টিউশন ছাড়াও শেখা যায় এই বোধটাই কি হারিয়ে গেল!
সে না হয় হল । কিন্তু সেখানেও তারা শিখছে কি? যদি শেখে ভালো কথা। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে না। যদি শিখত তাহলে তার প্রতিফলন ক্লাসের পরীক্ষাতে পড়ত। খাতায় তো কান্নাগুল্লি অবস্থা । সে অবস্থা ধীরে ধীরে জানতে পারবেন। তাহলে তারা খরচ করে পড়তে যাচ্ছে কেন ? কারণ বাবা মা জানে, ছাত্র-ছাত্রী জানে টিউশন একটা পড়তে হয় না হলে পিছিয়ে পড়তে হয়। তাই বাড়ি বাড়ি পরিচালিকার কাজ করে ভাত জোটানো মাও ছেলেমেয়েদের টিউশন দেন। ভাবেন ওখানেই তার মুক্তির চাবি লুকিয়ে। আর ছেলে মেয়েরা পায় নির্ভরতা। ওখানে ক্লাসের সময় কেটে বিবিধ কার্যক্রম হয়না। সিলেবাস সময় শেষ হয়। খুব বাধ্য না হলে শিক্ষক ছুটি নেয় না। কারণ সেখানে সরকারি চাকরির নিরাপত্তা নেই, প্রবল প্রতিযোগিতা। তারপর স্কুলের মত 4-5 ঘন্টা টানা নয়, ঘন্টা দুয়েকের ব্যাপার। সঙ্গে আবার ছেলে মেয়ে গা ঘেসে বসা ফ্রী। স্কুলে মাস্টাররা মানবে? সামান্য একটু ইয়ে মানে চোখ মারলেই কেমন খেক খেক করে!!
শহরের ও আধা শহরের টিউশন চরিত্রগতভাবে ভিন্ন। সেখানে সুপার স্পেস্যালিটির ছড়াছড়ি। শুরু হয়ে যায় প্রাক প্রাথমিক থেকে। ক্লাস থ্রির বাচ্চার তিনটা টিউশন, ক্লাস সেভেনের ছেলের আটটা । তার মধ্যে বিজ্ঞানেরই তিনটা যদিও বিজ্ঞান বই একটাই। ফিজিক্সের স্যার যদি কেমিস্ট্রির চিহ্ন সংকেত ভুল শিখিয়ে দেন তাই ছোট থেকেই বাবা-মা সতর্ক । এখানে এক একজন টিউশন টিচার চাকরির থেকে বেশি রোজগার করেন টিউশন পড়িয়ে। না পড়ালে অভিভাবক ভাবে ছেলে পিছিয়ে গেল। ফলে দরজার কাছে মাস্টারে মাস্টারে ঠোকাঠুকি লেগে যায়। বালক বালিকাদের কার্নিশ থেকে বেড়ালের লাফ দেখার সময়ও চুরি হয়ে যায়। এই বঙ্গে ডারউইন জন্মালে বিজ্ঞানী হওয়ার ক্ষেত্রে বিলকুল ফেল করতেন। ছাত্রাবস্থায় খেলনা বন্দুক হাতে বাগানে ঘুরে ঘুরে তার যে প্রকৃতি দেখার চোখটি তৈরি হয়েছিল সেটি কোন ভাবেই এখন হত না। দু বেলায় তাকে চারখানা টিউশন পড়তে হতো। পারফেক্ট করে দেওয়ার জন্য টিউশানে পরীক্ষা নেয় । একটি এইটের বাচ্চা বলল অঙ্কে অ্যানুয়াল এর আগে অক্টোবর নভেম্বরের মধ্যে তার চৌদ্দটা পরীক্ষা হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম বাড়তি অংক হয়? মানে বইয়ের বাইরে। বলল না বইয়ের অঙ্ক করে করে মুখস্থ হয়ে গেছে। চিন্তার বিকাশ নয় অধীত বিদ্যার নির্ভুলতা লক্ষ্য। অনন্ত সম্ভাবনার অঙ্কুরোদ্গম নয় একদম পারফেক্ট ছাঁচে ঢেলে দেওয়া। সেজন্য প্রতি টিউশন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা লাগে । মানে গড়ে ধরুন মাসে চার হাজার টাকা অভিভাবক ব্যয় করেন টিউশন পড়ার জন্য। আরও বেশি হতে পারে। আচ্ছা সেখানে কি শেখে? হ্যাঁ কিছুটা শেখে। তবে সবাই শেখে এরকম নয় । সেটা অবশ্য তাদের টিউশনের পরীক্ষা দেখে বোঝা যাবে না। কারণ এখানে জনঘনত্ব এত বেশি হয় যে নিজের খাতার দিকে তাকিয়ে পেরিফেরিকাল ভিশনে অন্যের খাতা সুন্দর দেখে নেওয়া যায়। দেখে লেখে কেন?কারণ অভিভাবক শ্যেন দৃষ্টিতে নম্বরে নজর রাখে। কম হলেই ‘ show cause’। বাঁচার জন্য সবাই মিথোজীবী হয়ে উঠে। সমাজের সবচেয়ে ‘ বন্দিত ‘ স্কিলটি শিখে নেয়। কোন কোন টিউশনে জায়গার অভাবে সামনের ছেলের পিঠে খাতা রেখে লিখতে হয় । একদিন দেখি রাস্তায় সাড়ে পাঁচটার সময় ছেলেকে মোটর বাইকের পিছনে বসিয়ে এক পরিচিত ভদ্রলোক যাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছেন? বললেন ছেলের টিউশন আছে। বললাম এত সকাল? আরো সকাল হয়, আজ একটু দেরি হয়ে গেছে। বিশেষ শিক্ষক আছেন তারা হয়ত গুলি বানিয়ে রাখেন। যেমন ধরুন দু পুরিয়া বীজগণিত, তিন পুরিয়া এপ্রোপ্রিয়েট প্রিপোজিশন ইত্যাদি ইত্যাদি। খাইয়ে দেন। তাই তার সময়ে অভিভাবক তথাস্তু করেছেন।এমন শিক্ষক বাড়িতে এলে 3- 5 হাজার নেন সপ্তাহে একদিন পড়াতে। এমন শেখাতে বদহজমের পরিমাণটা একটু বেশি হতে বাধ্য।
একটা ঘটনা শুনুন। সেকেন্ড গার্ল প্রমিতা একজনের কাছে ফিজিক্স পড়ে। মা বলেছে ফাস্ট গার্ল সমিতার কাছে জেনে আসবি ও কোথায় ফিজিক্স পড়ে? কারণ ফার্স্ট ইউনিটে সে এক নম্বর বেশি পেয়েছে। প্রমিতা সমিতাকে জিজ্ঞেস করে। সমিতা কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর মত ধোঁয়াশা ছড়িয়ে বলে এখানেও পড়তে পারি, ওখানেও পড়তে পারি, নাও পড়তে পারি, দুজনের কাছেও পড়তে পারি। অগত্য প্রমিতার মা গোয়েন্দাগিরি করেন কিছুদিন। খবর পাওয়া যায় জয়িতার মা সমিতাকে বেরোতে দেখেছেন ওমুক পাড়ার তমুক গলি থেকে। ব্যাস দুই দুই চার। প্রমিতাও গিয়ে ভর্তি হয় সমিতার টিউশনে। প্যান্ডেল হপিং এর মত টিউশন হপিং চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। মেয়ে ভাবতে শিখলো কিনা একদমই বিবেচ্য নয়। পণ্যটি কোথায় ঝকঝকে করে পরিবেশন করা হচ্ছে সেটি প্রধান।
টিউশন পড়লে ক্ষতি কি ? বেশ তো টিউশন আর স্কুল দুজায়গায় পড়লে তো ভালো। আজ্ঞে না স্কুলে ওরা পড়তে আসে না। শহরের এক নামী স্কুলের অভিভাবিকা বললেন ছেলে সপ্তাহে দু-তিন দিন স্কুল যায়। বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়, গল্প হয়। পড়ার জন্য স্কুল লাগেনা। যারা পড়াশুনা করে তাদের পড়ার পিছনে স্কুলের অবদান ওইটুকুই । যে কয়েকজন শিক্ষক পড়াতে চান ছাত্র-ছাত্রীদের চাপে পড়াতে পারেন না। কারণ তারা টিউশন পড়ে ক্লান্ত। স্কুলে এসেছে বিশ্রাম নিতে, আনন্দ করতে। কিছুদিনের মধ্যেই সেইসব শিক্ষকরা বুঝতে পারেন ‘ ছায়ার সাথে যুদ্ধ করে গাত্রে হল ব্যথা ‘। মুক্তির উপায় খুঁজে নেন, নিজের ঘর সংসারে মন দেন। শেয়ার বাজারে মন দেন।
(পরবর্তী অংশ পরের পর্বে)
7 Comments
My heartiest wishes to Mr Soumen Roy for his creative writing and I social reformer like activities, regards
ReplyDelete🙏🙏
Deleteসৌমেন এতোদিনের অভ্যাসের বোধহয় একটু রদবদলের আভাস দিলেন। এতোদিন ব্যবস্থাপনার গলি ঘুপচিতে ঘুরে বেড়ানোর পর এবার মধুভাণ্ডে ঢিল মারার কথা ভেবেছেন।
ReplyDeleteহ্যাঁ এখন থেকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক নিয়ে চলবে।মাঝে একটি টি এল এম নিয়ে।🙏
Deleteগ্রামের কোচিং সেন্টার ও টোলের যে রসপূর্ণ বর্ণনা সৌমেন দিয়েছেন তা পাঠকদের কাছে মুখরোচক মনে হলেও আসলে এক সংবেদনশীল শিক্ষকের অসহায়তা প্রতিটি শব্দের মধ্যে যেন ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে।
ReplyDeleteসমব্যথীরাই অনুভব করে। ধন্যবাদ।🙏
ReplyDeleteRegards .🙏🙏🙏🙏🙏
ReplyDelete