জ্বলদর্চি

বেড়ি পরতে পরতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ছি যে খুলে দিলে অস্বস্তি হয় /মানসী কবিরাজ

বেড়ি পরতে পরতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ছি যে খুলে দিলে অস্বস্তি হয়

মানসী কবিরাজ


 ধরুন যদি লিখি  ‘ঙঞণনম’ । কিছু বোঝা বা উচ্চারণ  করা গেল ! বোঝা গেল না তাই তো ? অবশ্য যদি ‘কচটতপ’ লিখি বুঝতে খানিকটা সুবিধা হবে নিশ্চয়ই । স্বাধীনতা বিষয়টাও কিছুটা ওরম ধরনের । কাঁঠালের আমসত্ত্ব কিংবা হাঁসজারু গোছের । 

ডিক্সনারিতে  স্বাধীনতা বা independence এর অর্থ লেখা আছে : ফ্রিডম ফ্রম কন্ট্রোল , ইনফ্লুয়েন্স , সাপোর্ট, এইড অর দ্য লাইক অফ আদার্স । আবার কোথাও স্বাধীনতার অর্থ বলেছে –দ্য পাওয়ার অর রাইট টু এ্যাক্ট , স্পিক অর থিংক অ্যাজ ওয়ান ওয়ান্টস উইদাউট হিন্ডারেন্স অর রেসট্রেইন্ট ।  কোথাও স্বাধীনতার অর্থ লেখা - দ্য এবিলিটি টু লিভ ইয়োর লাইফ উইডাউট বিয়িং হেল্পড অর ইনফ্লুয়েন্সড বাই আদার পিপল .....

এই  এবিলিটি টু লিভ ইয়োর লাইফ উইডাউট বিয়িং হেল্পড অর ইনফ্লুয়েন্সড বাই আদার পিপল  শুনলেই মনে হয়  চিৎকার করে বলে উঠি  , আমি কীভাবে বেঁচে আছি তুই দেখে যা নিখিলেশ ‘ । না আমার কোনও নিখিলেশ নেই।  এসব বলার মতো একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউই নেই । নিজেই নিজেকে চিমটি কাটি । সত্যিই স্বাধীন দেশে স্বাধীন ভাবে বেঁচেবর্তে  আছি তো ! নাকি হেক্সাগন ঘুলঘুলি চুঁইয়ে আসা টুকরো টুকরো বাতাসের মতো বন্ধ দেওয়ালের গায়ে লেগে আছি  কিংকর্তব্য বিমূঢ়  ফটোফ্রেম হয়ে ! ইথারগ্রস্ত আঙুলে  সার্চইঞ্জিন খুঁজি । সত্যিই স্বাধীন ! নাকি বালিশ বদল করে অন্য কারোর স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গিয়ে ভাবছি- আমি  একদম নিজের মতো আছি ! দেখছি শুনছি হাসছি খঞ্জনী বাজাচ্ছি , মানে  যা যা করার কথা সেসবই করছি অথচ আমি যে উইডাউট বিয়িং হেল্পড অর ইনফ্লুয়েন্সড বাই আদার পিপল হয়ে আছি এই বোধটাকে ছুঁতে পারছি না । যে থাকাটাকে বলছি দিব্য আছি , সেতো অন্যের চশমায় নিজেকে দ্যাখা ।  যখন যেমন যতটা চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দম ভরে দিচ্ছে , তখন তেমন ততটা ঝাঁপতাল । চারপাশে যতটা আধুনিকতা উপছে পড়ছে পোশাকে ঠাটে বাটে , চেরা জিভের ডগায় যত স্ল্যাঙের প্রবাহ ততটা আধুনিক নয় দর্শনের দৃষ্টি ! আর ঘুরেফিরে রক্ষণশীলতার ঠাণ্ডা চাবুক আছড়ে পড়ছে সেই আমার পিঠে  ।  তবুও সাত চড়ে রা না কাড়ার  স্বাধীনতায় আছি ! আছি পুরনো কাসুন্দির মতো স্থুলোদর কাচের বয়ামের গায়ে লেপ্টে থাকা ঠাণ্ডা হয়ে । আসলে প্রত্যেকেই তার নিজস্বতা ধরে রাখতে চায়  ভিতরে ভিতরে , যেমন পাথর অনন্তকাল পাথরই থাকে ভাস্কর যতই  ছেনি হাতুড়ি মারুক  আর জবজবে আত্মপ্রসাদে ভাবতে থাকুক -দিয়েছি  রূপকল্প দিয়েছি বদলে  , পাথর আদতে পাথরই থাকে ।  তাই থাকুক  হাতুড়ির দাগ। থাকুক তীব্র হয়ে । অনুদানের প্রাণ প্রতিষ্ঠার চেয়ে পাষাণ প্রতিমা হয়ে থাকা ঢের ভালো ।  

আমার আয়ুরেখায় লেগে আছে মৃত নক্ষত্রের গন্ধভার । যে গন্ধরা না যেতে পারছে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে , না পারছে মাটির বুকে শুয়ে মাটি হয়ে যেতে। আমি  সেই  মৃত নক্ষত্ররাজির গন্ধভার বিভাজিকার মধ্যে পুরে নিতে নিতে বলি – আছি আছি এইভাবেই আছি- এই যে শিকড় উপড়ে নেওয়া থাকা , এই যে ঠিকানা বদলের থাকা , এই যে এক উঠোন থেকে অন্য উঠোন তারপর  আরও অন্য ... এই যে নাম গোত্র পদবি হারিয়ে ফেলে থাকা ... এভাবেই স্বাধীন হয়ে আছি  । রান্নাঘরের তাকে গুছিয়ে রাখছি দুর্বা ও ধান । শিলনোড়ার ছন্দে সেরেল্যাকের গন্ধে ঢেকে যাচ্ছে আমার সিঁথির আলপথ ।  এই যে শুধু মাত্র কন্যা স্ত্রী অথবা মায়ের ভূমিকার স্বাধীনতা  । সেকী আর চাট্টিখানি কথা ? তাই ভালো মেয়ে ভালো বউ ভালো মা হয়েই এ জীবন দিতেছি বইয়ে। 

🍂

      আসলে বেড়ি পরতে পরতে এতটাই অভ্যস্ত হয় গেছি যে খুলে দিলেই কেমন একটা অস্বস্তি হয়।মনে হয় যেন এই বরাদ্দের বাইরের অক্সিজেন আর বুক চিতিয়ে পাম্প করতে পারছে না এতদিনের হাঘরে ফুসফুস । ঐ যেমন অনভ্যাসের চন্দন কপালে লাগালে চড়চড় করে । তাপর ধরুন নেড়ি কুকুরকে আদর করে ঘি-ভাত বেড়ে দিলে লোম টোম উঠে  এক্কেবারে পুরো সিস্টেমটাই ছানা কেটে হ্যাং হয়ে যায় । তাই এভাবেই পরতে পরতে ফেভিকলের মতো চিপকে আছি বেড়ির আদতে ।

আসলে  স্বাধীনতা ব্যাপারটা ঘটেই অন্যকে পরাধীন করে । অন্যকে পরাধীন না করে নিজে স্বাধীন ভাবে থাকা আর অন্ধকার ছাড়া আলোর অস্তিত্ব অনুভব করা একই রকম ইউটোপিয়া । 

অবশ্য স্বাধীন দেশে সবাই স্বাধীন । আমি আপনি থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধ বণিতা প্রত্যেকে । এই আজাদী কা অমৃত মহোৎসবে গোদা বাংলায় এই দীর্ঘ আকাম এ  ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে ‘ গান গাইতে গাইতে  বগল বাজিয়ে টুক করে ঢুকে পড়ি নিজের ব্যক্তি চৌহদ্দিতে ......

              খেলতে খেলতে আমার  ছোট বাইরে ( ওভাবেই শেখানো হতো ) পায় , সঙ্গী ছেলেটিরও পায় এবং আবিষ্কার করি  কোথাও কিছু একটা  আলাদা । সে দাঁড়িয়ে  স্বচ্ছন্দ আমি বসে ।  অপার বিস্ময়  খুলে বলি বাড়িতে । সেদিন থেকেই আমার চারপাশে  প্রাচীর  এবং প্রাচীরে জ্বলজ্বলে চেতাবনি - যা ছেলেটি করতে পারে , আমি পারি না । শুরু হয় ‘ না’ এ মোড়া এক স্বাধীন জীবন ।

 ছেলেটির মতো  যেখানে সেখানে বা কারো সামনে ছোট বাইরে নৈব নৈব চ , সে  ব্লাডার ফেটে যাবার যোগাড় হ’লেও না ।আর বড় বাইরের কথা তো মনে মনেও উচ্চারণ করা পাপ। পিরিয়ড় বললে নির্ঘাত নরকবাস।  সমস্ত নেচার’স কল চেপেচুপেও আহা ! বাধাহীন স্বাধীন স্বাধীন । 

 ছেলেদের সঙ্গে খেলা , ছেলেদের মতো খেলা আমাকে মানায় না । হলেও বা খেলনাগাড়ি  ! গাড়ি মানে তো স্পিড।  মেয়েদের বাপু অত স্পিড ভালো না । মানিয়ে গুছিয়ে চলো । তাই  পুতুল খেলা । ধুলো গুলে গুলে ভাত রান্না । ইট গুড়োর মশলা ।বোতলের ঢাকনা চেপে চেপে গোল গোল করে পাতা কেটে লুচি ভাজা থেকে শুরু করে সংসারের হাঁ মুখ চুল্লী  নেভাও ।  এই রাঁধার পর খাওয়া আর খাওয়ার পর রাঁধা জীবন ভর এক চাকাতেই বাঁধার   স্বাধীনতা নিয়েই আছি……

           ছেলে তো নয় যে হুট বলতেই বহুমূল্য হায়ার এডুকেশনের জন্য বাইরে পড়তে চলে যাবে !  ব্যাস সালিশি সভায় রায় ঘোষণা হয়ে গেল। না ডিডিএলজে মুভির লাস্ট সিনে ওমরেশ পুরির সেই হৃদয় গলিয়ে দেওয়া বিখ্যাত ডায়লগ ‘ যা সিমরন যা । জি লে আপনা জিন্দেগি’ টাইপের নয় (ওসব কেবল সিনেমাতেই হয়) বরং তীক্ষ্ণ অভিভাবকীয় সরগমে -এইসব লক্ষণ নাকি মোটেই সুবিধার নয় ।বেশী বিদ্যেবাগীশ হলে শেষে পাত্র জোটা দায় ! কাজেই অপরাধী জানিতেই পারিল না কী তাহার অপরাধ ! ম্যাট্রিমনিসাইটে এনলিস্টেড হয়ে গেল  নামখানা তার । হেই সামালো ধান হো কাস্তেটা থুড়ি বিবাহেতে দাও শান হো  ।  লাল বেনারসি । জড়োয়া সেট ।  আহা মরতে দম তক্ এমন পাকাপোক্ত  খাঁচায় ডানা ঝাপটানোর যশোগাথা  ! একী কম স্বাধীনতা !

      চিৎকার করে কথা বলা  , শব্দ করে হাসা ,খোলা চুলে থাকা, পা ফাঁক করে দাঁড়ানো , একা একা  বাইরে যাওয়া, ঘরকন্না ছেড়ে বইপত্তর পড়া ,খিদে পেলে খাওয়া ,প্রেম পেলে বলা, রাগ হলে দেখানো, সেক্স পেলে এগোনো  সবতেই মস্ত এক ‘না’ এর স্বাধীনতা। এই শাস্ত্রীয় সংগীতের মতো রাশভারী ‘না’এদের নিয়েই তো আছি বেশ ধোপদুরস্ত স্বাধীন সত্তায় এবং কীভাবে এই অপরিমিত ফ্রাস্টেশানের বুদবুদ বুকে নিয়ে আছি এটা বলার মতোও যখন কেউ নেই তখনও আছি ।

                      সুখের গোলাপি মেখে হাড়িকাঠে পেতে রেখেছি বার্বিডল গ্রীবার নরম । মেপে মেপে একশ এমএল ছায়া মেপে মেপে  একশ এমএল রোদ বেড়ে দিচ্ছি হুকুম মোতাবেক । তিলকসেবা আঁকছি চার দেওয়াল জুড়ে । মিছরির পানা রাখছি সুতীব্র ভল্ল ডগায় । ইনফারনো খুঁড়ে আনছি পদাবলি ধুন  । সমস্ত শীত জমিয়ে রাখছি ব্রাত্য ধুলোদের মতো বৈঠকখানার কার্পেটের নীচে । উপরে মহার্ঘ্য সোফাসেট ।  টেক্সচারড্ দেওয়ালে ভ্যান ঘঁগের পেইন্টিং রেপ্লিকা । ডলবি সাউন্ডে বাজছে জুবিন মেহতা ।সমস্ত নীল  ঢেকে রাখছি চারকোল কাজলে , নো মেকআপ লুক  ফাউন্ডেশানের প্রলেপে ,  ন্যুড লিপস্টিকের গাঢ়তে । অনামিকা থেকে খসে যাচ্ছে নদীর গহীন । লক্ষ্মণরেখার বাইরে পা রাখতে না রাখতেই বেজে উঠছে তীব্র সাইরেন । ১৪৪ ধারা জারি করে মার্চপাস্ট করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে তাবৎ  মনু সংহিতা। সমস্ত সম্পর্ক থেকে পলেস্তারা খুলে পড়ছে  ঝুরঝুর করে। যেন মাংস ও মেদহীন এক এক্সরে প্লেট ।  সেই থেকে উদ্বাহু হয়ে অনন্ত আকাশের নিচে স্বাধীন দাঁড়িয়ে আছি একা এবং একাই , ভিড় বাসের মধ্যে স্বাধীন দাঁড়িয়ে আছি একা এবং একাই , চব্বিশ ক্যারাটের নৈঃশব্দ্য জিভে নিয়ে স্বাধীন বেঁচে আছি একা এবং একাই .........

        নিজেকে নিজেই  রাঁধছি নিজেকে নিজেই বেড়ে দিচ্ছি প্রতিদিন । কোনদিন কসৌরি মেথি , কোনদিন টমেটো কেচাপ , কখনও কালো জিরা কাঁচা লংকা কখনও গোলমরিচ টক দই আর আদা । আমার ভিতরের ডোম পাত পেড়ে খাচ্ছে আমাকেই ।

আমার পাঁজর থেকে মুছে যাচ্ছে ভ্রান্ত স্বাধীনতার মোহ । মুছে যাচ্ছে  রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের – ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় .... ‘ হাওয়া মোরগের ডানায় বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া দপ্তর । মৃত নক্ষত্ররাজির গন্ধভার থেকে উঠে আসছে নদী । আর কে না জানে নদী আপন বেগে পাগল পারা ! তাই একদিন ঠিক , একদিন ঠিক হলুদ সংকেতে লেখা বিপদসীমা ডিঙিয়ে অন্য কোনও এক অনুপম স্বাধীনতায় আস্টেপৃষ্টে ডুবে যাব ভেবে  

প্রাণপণ খড়কুটো ।

প্রাণপণ ভেসে ভেসে আছি আজও .....

Post a Comment

1 Comments

  1. বাহ্!

    খুব ভালো লাগলো!!!

    ReplyDelete