দেহান্তর
পুলক কান্তি কর
- মেসোমশাই, আপনার নাম আর বয়সটা বলুন। প্রেশকিপশান প্যাডটা বের করে জিজ্ঞাসা করল রামানুজ। ডাক্তার রামানুজ বন্দোপাধ্যায়। সদ্য সদ্য এম.ডি করেছে সে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
- আমার নাম নিখিলেশ মজুমদার। চুরাশি বছর বয়স।
- আপনার সমস্যা কি?
- আমার কোনও সমস্যা নেই। এই বয়স জনিত যা যা হয় - সবই আছে তবে ওরা আমাকে তেমন ট্রাবল দিতে পারে না।
- কেন?
- আমি তো ওগুলোকে বয়সের ধর্ম বলে মেনেই নিয়েছি। ওদের আমি সমস্যা ভাবি না।
- আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন কিছু?
- অভিযোগ করার মত নয়। আমার দৈনন্দিন কাজে লাগে এমন কিছু যখন ভুলি নি - তখন ভুলে যাই বলে বিলাসিতা করা কি আমার সাজে? তুমি কী বল হে ডাক্তার? যাকে নিয়মিত আরাধনা করি না, সে আমার ডাকে সাড়া দেবে কেন?
চুপ করে রইল রামানুজ। বলল, আপনার হাত পা কি কাঁপে?
- আমি সচেতন থাকলে কাঁপতে দিই না। অবচেতনে বোধহয় কাঁপে। বাড়ীর লোকরা তো তেমন বলে।
রামানুজ প্রেশার মাপার যন্ত্রটা বের করে প্রেশার মাপলো। তারপরেই খস খস করে দু-তিনটে ওষুধ লিখে দিল।
- কী লিখেছ ডাক্তার?
- ওই একটু ওষুধ দিয়ে দিলাম। হাত পা কাঁপা কম থাকবে। মনটা ভালো হবে। ঘুমটা ভালো হবে।
- ঘুম ভালো হবে কি গো! তোমরা এমন ঔষধ লেখো আমি সারাদিন শুধু পড়ে পড়ে ঘুমোই। ঘুমোলে মন কাজ করবে কি করে? আর মন কাজ না করলে ভাবব কি?
- আপনি বেশী যাতে না ভাবেন – সেই চেষ্টাই তো করা মেসোমশাই।
- না ভাবলে বেঁচে থাকার কী মানে হয় ডাক্তার?
- বেশী ভাবনাও একটা সমস্যা হয়ে যায় কখনও কখনও। মানুষ তখন অসংলগ্ন কাজ করে ফেলে।
- ডাক্তার, তোমরা তো একালের ছেলে ছোকরা। তুমি ঋষি বিশ্বামিত্রের নাম শুনেছ?
- শুনেছি, কেন বলুন তো?
- ঋষি বিশ্বামিত্র জাতে ক্ষত্রিয় ছিলেন, জানো কি?
- না।
- অবশ্য তোমরা জানবেই বা কী করে। ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পেতেই সতেরো আঠারো বছর রগড়াতে হয়। তারপর ডাক্তারী পড়া, এম.ডি করা - এসবেই তো জীবন কেটে গেল তোমাদের। পুরাণ টুরানের গল্প জানবে কি করে?
- ওঁর ক্ষত্রিয় হওয়ার সাথে এখনকার কি সম্পর্ক? একটু অসহিষ্ণু হয়ে বলল রামানুজ।
- বলছি বলছি। একটু সবুর ধর। ঋষি বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় ছিলেন জন্মসূত্রে। তাঁর ইচ্ছে ছিল তিনি ব্রাহ্মণ হবেন। এ জন্য প্রচুর সাধনা টাধনা করলেন অনেক বছর। অবশেষে ব্রহ্মা দেখা দিয়ে বললেন, তুমি ব্রাহ্মণ হলে আমাদের কোনও অসুবিধা নেই। তবে বশিষ্ঠ মুনি যদি তোমাকে ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করে নেন, তবে এই পৃথিবীর সবাই তোমাকে ব্রাহ্মণ বলে মান্যতা দেবে। বিশ্বামিত্র বললেন, এ আর এমন কী! খুশী হয়ে তিনি বশিষ্ঠের কাছে গেলেন। বশিষ্ঠ কিন্তু কিছুতেই তাঁকে ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করতে রাজী হলেন না। তখন বিশ্বামিত্র রেগে গিয়ে বশিষ্ঠের পুত্রদের হত্যা করলেন। আরও কিছু দিন গেল - বিশ্বামিত্রের ভয়েও বশিষ্ঠ তাঁকে ব্রাহ্মণের স্বীকৃতি দিলেন না। বিশ্বামিত্রও ধৈর্যহারা হলেন। তিনি একদিন ঠিক করে নিলেন ব্রাহ্মণ হওয়ার পথে বশিষ্ঠই যখন বাগড়া দিচ্ছেন, উনি ওকেই হত্যা করবেন। এই মনোরথ নিয়ে বিশ্বামিত্র এলেন বশিষ্ঠর কুটীরে। এসে শুনলেন বশিষ্ঠর স্ত্রী বশিষ্ঠকে বলছেন, ‘তোমার কী এমন যাবে আসবে যদি তুমি বিশ্বামিত্রকে ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার কর? এত ব্রাহ্মণ আছে সমাজে। সেখানে যদি একটা ব্রাহ্মণ বেড়ে যায় – তোমার কী ক্ষতি? উত্তরে বশিষ্ঠ বললেন, ‘দ্যাখো ওকে আমি ব্রাহ্মণ বলবই বা কী করে? ও তো ক্রোধকেই জয় করতে পারে নি! ব্রাহ্মণের তো ক্রোধ থাকার কথা নয়!’
রামানুজ অনেকক্ষণই উশখুশ করছিল। এবার আড় চোখে ওর হাতঘড়িটা দেখে বলল, ‘বিশ্বামিত্র শুনে টুনে কী বলল?’
- বিশ্বামিত্র সব শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। উনি এসে বশিষ্ঠকে প্রণাম করে বললেন, আমি ব্রাহ্মণ হতে চাই না। আপনি আমার কৃতকর্মের জন্য আমাকে মার্জনা করুন’। বশিষ্ঠ বললেন ‘এইবার তুমি ব্রাহ্মণ হওয়ার যোগ্য হলে’।
- কিন্তু এই গল্পটা আমায় শোনালেন কেন?
- কারণ তুমিও এখনও প্রকৃত ডাক্তার হতে পারোনি। সাধনাটুকু করেছ শুধু।
- একথা আপনার মনে হওয়ার কারণ? রামানুজের গলায় যথেষ্ট উষ্মা।
- কারণ তুমি নীচে আমার ছেলে বউমাদের কাছ থেকে শুনেই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছ আমার মাথার গোলমাল আছে, আমি অসংলগ্ন কথা বলি - আর তুমিও খসখস করে সেইমত ওষুধ লিখে দিলে।
হঠাৎ করে যেন চাবুক পড়ল রামানুজের পিঠে। তাই তো! সে তো ঠিক তাই করেছে। তবু গলায় অসন্তোষ এনে বলল, আপনি বুঝে গেলেন ওষুধের নাম দেখেই - কী ওষুধ দিয়েছি আমি?
- বুঝব না? তোমরাই তো বল - দুনিয়া এখন মুঠ্ঠি মে। এখন চাইলে মানুষ কী না জানতে পারে? এই ওষুধ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমার বিগত পাঁচজন ডাক্তার নানান ট্রেড নেম এ লিখেছেন, আমি ওর এফেক্ট, সাইড এফেক্ট - সব পড়ে দেখে নিয়েছি।
- তাহলে তো আপনি ডাক্তার হয়ে গেছেন। আমাকে আর ডাকার দরকার কি?
নিখিলেশ হাসলেন। মুখে কিছু বললেন না। এই চুপ থাকা হজম করতে পারল না রামানুজ। ততোধিক অসহিষ্ণু হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা- মেসোমশাই - আমার কী করা উচিৎ ছিল বলে মনে হয় আপনার?
- ওটা তো তোমার কাজ। তুমিই এটা আমার থেকে ভালো জানবে ডাক্তার!
- আমি জানিনা। সত্যি আমি জানতে চাই – আমি কোনও রাগ থেকে বলছি না। আপনি বলুন। পেশেন্টের ভিউটাও আমার জানা উচিৎ। হঠাৎ করে স্বাভাবিক গলায় ফিরে এল রামানুজ।
- তুমি মনের ডাক্তার। তুমি যদি আমার সাথে কথা না বলো, গল্প না করো – তুমি জানবে কী করে আমার তার কতটা কাটা? আমি কতটা পাগল তুমি না বুঝলে, ওষুধে কাজই বা করবে কেন?
চুপ করে রইল রামানুজ। কথাটা তো সত্যিই। আসলে এত সময় কোথায়? তেমন করে ভাবতে হল তো এক একটা রোগীর পেছনে কয়েক ঘন্টা চলে যাবে। দু-তিন মিনিটে কি শুধু সিম্পটন শুনে চিকিৎসা করা যায়?
- কী ভাবছ? সময় কোথায়? আমিও বুঝি ডাক্তার। সময়টাই দৌড়াচ্ছে। তুমি সেই সময়ের সাথে না দৌড়াতে পারলে বা অন্য রকম দৌড়াতে চাইলে তুমি মনোরোগী।
- ঠিকই বলেছেন মেসোমশাই। আমরা ভাবি ‘এটাই আমাদের অভিজ্ঞতা’। ভাতের একটা চাল টিপলে যেমন বোঝা যায় তেমনি আমরাও দাবী করি – রোগীর সাথে দু-পাঁচ মিনিট কথা বললেই আমরা তার সবটা বুঝে যাই। আসলে বহু কেস এমনি মিছিমিছি ওষুধ খেয়ে যায় বছরের পর বছর, হয় তো সারাজীবন। শুধু ভেজিটেটিভ ষ্টেটেই বেঁচে থাকে তারা - ঘুম পাড়ানো জীবন্ত লাশ।
- জানো ডাক্তার – মানসিক রোগী কাকে বলে?
- আমি তো ডেফিনেশন জানি, কিন্তু আপনি ঠিক কী শুনতে চাইছেন, বুঝতে পারছি না।
- আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে কি বলেছে জানো? ধী বিভ্রম সত্ত্ব পরিপ্লবশ্চ/ পর্্যাকুলা দৃষ্টি অধীরতা চ/ অবদ্ধ বাক্যং, হৃদয়ঞ্চ শূণ্যম্/ সামান্য উন্মাদ গদশ্চ লিঙ্গম/ স মূঢ চেতা – ন সুখং ন দুঃখং/ নাচারো ধর্ম কুত মেব শান্তি/ বিন্দ্যস্তপাস্ত স্মৃতি ভক্তি সংজ্ঞা/ ভ্রমস্ততং চেত ইতস্ততশ্চ।
- কিছুই তো বুঝলাম না! পুরো তো সাংষ্কৃট্।
- হ্যাঁ সংষ্কৃতেই লেখা। এর অর্থটা এরকম – আচ্ছা তুমি ঘড়ি দেখছিলে ঘন ঘন, তোমার তাড়া নেই তো?
- না না বলুন না। শুনতে ভালো লাগছে। আমারও ত জানার দরকার। আফটার অল - আমি এই বিষয় নিয়েই ডিল করি।
- তাহলে শোন। এর মানেটা হল - উন্মাদ আমরা তাকেই বলব যার বুদ্ধি ভ্রমিত; মানে ইন্দ্রিয়গুলোর জ্ঞানার্জনে যখন নানান ত্রুটি হচ্ছে, মন চঞ্চল হয়ে উঠছে, চোখের দৃষ্টিতে ব্যাকুলতা ভরা, সব সময় কেমন একটা অস্থিরতা, কথাবার্তার ঠিক নেই এবং হৃদয়ের শূন্যতা। হৃদয়ের শূন্যতা তোমাকে এখন বোঝাতে গেলে সময় যাবে ডাক্তার, অন্যদিন বলব।
- পরের স্ট্যানজাটার মানে তো বললেন না?
- পরেরটায় বলছে – এমন মানুষের সুখ এবং দু;খের বোধ থাকে না, সে তার চেতনার ব্যাপারে মূঢ অর্থাৎ সাধারনের কথায় – দ্যাখ কেমন বোকা বোকা, সে তার ধর্মাচরণ সঠিক ভাবে করতে পারে না। এখানে ধর্ম মানে হিন্দু-মুসলিম নয়, এখানে ধর্ম মানে দৈনন্দিন শারীর বৃত্তীয় কাজের পালন। এদের মনে শান্তি থাকে না, এদের স্মৃতি, ভক্তি, সংজ্ঞা নষ্ট হয়। এখানে স্মৃতি ভক্তি বা সংজ্ঞার নির্দিষ্ট অর্থ আছে, আমরা স্বাভাবিক ভাবে যা মনে করি, তেমনটা নয়। এরা অকারণ ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় বা এদের মনের চিন্তাভাবনা গুলো ইতস্তত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরন করে – যেটা একটা সাধারন মানুষ সচরাচর করে না।
- বাঃ। খুব সুন্দর ডেফিনেশন তো। পৃথিবীর সমস্ত ভ্যারাইটির মনের রোগ এসে গেল এর মধ্যে।
- আচ্ছা ডাক্তার, এই ডেফিনেশনের আত্ততায় আমি পড়ি কি?
- সেটা তো আমাকে বেশ কিছুদিন আপনার সংস্পর্শে থেকে বিচার করতে হবে মেসোমশাই। অবশ্য এটা আমার কথা নয়, আপনারই প্রস্তাব।
- তাহলে নীচে আমার ছেলে বৌমাকে কী বলবে? ওরা তো জানতে চাইবে - কেমন দেখলে।
- বলব আপনি বেশ সুস্থই আছেন, তেমন কোনও অসংলগ্নতা আমার চোখে পড়ল না।
- পাগল! ওসব বলতে যেও না। তাহলে তোমাকে বাদ দিয়ে অন্য ডাক্তার দেখাবে। তার চেয়ে তুমি বলো – ‘একটু সমস্যা আছে। ওষুধ পত্র লিখে দিয়েছি। তুমি তাহলে মাঝে মাঝে আমার কাছে আসতে পারবে, ফীস্টাও পাবে।
- আপনার তাতে কী লাভ?
- তুমি আমার চেনা হয়ে গেছে। তোমাকে নতুন করে আবার বোঝাতে হবে না। তারচেয়ে বড় কথা – তোমাকে আমার ভালো লেগেছে কথা বলে।
- আপনি আর আমার কথা কি শুনলেন? আজ তো আমিই আপনার কথা শুনলাম। যাই হোক আজ উঠি। সপ্তাহ তিনেক পরে আবার আসবো।
- ওষুধের কি হবে? ওগুলো কি খাবো?
- আপনি আগে কি করতেন? আগের ডাক্তারের ওষুধ কি খেতেন?
- না। ছেলে কিনে দিত। আমি রোজ ওগুলোকে কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ টেনে দিতাম।
- এগুলোও তাই করবেন নিশ্চই। আমি বললে কি খাবেন?
- এতসব কথা বলাবলির পর যদি খেতে বলো, খাবো।
- তাহলে এই তিন নম্বরের ওষুধটা শুধু খাবেন। এটা একটা ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট। বাকীগুলো খাওয়ার দরকার নেই। আজ চলি।
- আচ্ছা এসো।
মাসখানেক পরে আবার এক বিকেলে রামানুজ এল নিখিলেশের বাড়ী। ওর বাড়ীর লোকজনেরা বলল - সমস্যা নাকি ক্রমাগত বাড়ছে। রামানুজ মনে মনে ভাবলো রোগ তো বাড়বেই। ওষুধই বা কি চলছে! সাধারনত এই ধরণের রোগীর সাথে সে নিভৃতেই কথা বলে। আজও বাড়ীর লোককে নীচে থাকতে বলে সে উঠে এল উপরে নিখিলেশের ঘরে। বেশ পরিপাটী করে গোছানো বড় একটা ঘর। এককোণে মস্ত দুখানা বই এর র্যাক। একটা আলমারি, চেয়ার টেবিল। নিখিলেশ চেয়ারেই বসে ছিলেন। ওকে দেখে হাত তুলে অভ্যর্থনা করলেন। রামানুজ জিজ্ঞাসা করল - কেমন আছেন মেসোমশাই?
- আমি তো সব সময় ভালো থাকি ডাক্তার। তবে কিনা সারাদিন ঘরে বসে থাকি তো! নিজেকে কেমন অমল মনে হয়। কবে যে দইওলা আসবে!
- আপনি বাইরে বেরোন না কেন?
- আমাকে যেতে দেয় না তো! কোথাও যদি ওরা যায়, আর যদি মনে করে আমি সেখানে যাবার যোগ্য, তবেই নিয়ে যায়। বছরে এরকম আর কদিন হয় বলো? আর নিজে নিজে না গেলে কি চারপাশের সাথে একাত্ম হওয়া যায়?
- কিন্তু এই বয়সে আপনাকে একা একা ছাড়াটাও কি বাস্তব সম্মত?
- আসলে অতি যত্নও কখনও কখনও বোঝা হয়ে যায় ডাক্তার! আমার ছেলে বৌমা নাতি – এরা আমার শরীরের এত খেয়াল রাখে যে আমার মনের দমবন্ধ হয়ে যায়। তুমি একটু এদের বলে যাও না যাতে আমাকে রোজ বিকেলে বাইরে যেতে দেয়!
- সে না হয় বলব, কিন্তু একা ছাড়া যাবে না। তাতে রাজী তো?
- নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো।
- ঠিক আছে, আমি বলে যাব যাতে আপনাকে রোজ কাছাকাছি কোনও পার্কে সকাল বিকেল নিয়ে যায়।
- একবেলাই বলো ডাক্তার! দুবেলা বললে আদৌ হবে না। এরা তো লোক দিয়ে আমাকে পাঠাবে – এমনটা নয়! নিজেরাই নিয়ে যাবে – সুতরাং একবেলাই সই। অন্তত বৃদ্ধ চোখে জগৎটা কে একবার দেখি। আমাদের আমলে ‘দেখব এবার জগৎটাকে’ বলে একটা কবিতা পাঠ্যবইতে ছিল। তোমরা কি পড়েছ কবিতাটা।
- না।
- ওঃ। এখন তো আবার সবাই ইংরাজী মাধ্যম।
- আচ্ছা – এখন একটু চুপ করে বসুন। আপনার প্রেশার ট্রেশার গুলো দেখি।
রামানুজ প্রেশার মেপে পালস দেখে লিখে রাখল প্যাডে। চোখ টেনে দেখল, জিভ পরীক্ষা করল – হঠাৎ স্থির হয়ে গেল নিখিলেশের একটা কথায় – ‘তোমার কি মন ভালো নেই ডাক্তার?’
- কেন বলুন তো?
- বলই না! সত্যি কথা বলবে কিন্তু।
- না, ভালো নেই। কিন্তু আপনি বুঝলেন কি করে? আমি তো আপনার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছি।
- তোমার ছোঁয়ায়। মানুষকে ছুঁলে ওর মনটাকেও ছোঁয়া যায় ডাক্তার।
- তাই না কি?
- হ্যাঁ। স্পর্শ হচ্ছে মানুষের পাঁচটা জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মধ্যে সবথেকে সেরা অনুভব করার ইন্দ্রিয়। চোখ-কান নাক যেমনটা দেখবে শুনবে তেমনটাই তোমাকে জানাবে। কিন্তু স্পর্শ ঠিক সেরকম নয়। কখনও সে তোমাকে ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়ও জানাবে। এই যে তোমরা নাড়ী দেখ - সেও তো ছোঁয়াই। কী দেখ তাতে?
- এই হার্টরেট, তার রিদম, ভল্যুম, টেনশান এসবই দেখি।
- মোদ্দা কথা তোমরা হৃদয়কে ছুঁয়ে দেখ, তাইতো? হৃদয় সুস্থ আছে কিনা! জানো তো – আমাদের ছোটোবেলায় এই পাড়াতে এক কোবরেজ থাকতেন। ওনার নাম ছিল রাখাল কবিরাজ। উনি এই নাড়ীতে হাত দিয়ে শরীরের কোন অঙ্গে কি গোলমাল বলে দিতে পারতেন। একদিন আমাকে বললেন – তোমার নাড়ীটা বেশ স্নিগ্ধ এবং মৃদু। আমি তো কিছুই বুঝিনি তখন। এখন ভাবি, একটা ধমনীর গতির মধ্যে স্নিগ্ধতা বা মৃদুতাও স্পর্শ দিয়ে বোঝা যায় - চেষ্টা করলে!
- সত্যি কথা, আগের মানুষেরা কত কী এক্সট্রা সেনসরি ব্যাপার সেন্স করতে পারতো।
- সে তো হল। এখন তোমার মন খারাপের কারণটা শুনি।
রামানুজ চুপ করে রইল। নিখিলেশ বললেন, ‘হৃদয় ঘটিত নাকি?’
- হ্যাঁ।
- কী হল হৃদয়ে? বসিয়া বিরলে, থাকিয়ে একয়ে, না শোনে কাহারো কথা?
- অনিতা, মানে যাকে আমি পছন্দ করি, তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
- সেও ডাক্তার নাকি?
- না, না – আমাদের পাড়ারই মেয়ে। আমার বন্ধুর বোন।
- তাকে প্রপোজ করেছ?
- না। সাহস পাইনি।
- কেন? ভয়টা কিসের? তুমি ডাক্তার, এস্টাব্লিশড। তোমাকে অপছন্দের তো কিছু নেই!
- ডাক্তার বলেই আমাকে ভালবাসবে – এমনটা ভাবাটাও কি ঠিক মেসোমশাই?
- আমি সে ভাবে বলছি না ডাক্তার! আমি বলছি মেয়েটি বা মেয়েটির বাবা যদি বাস্তবটা দেখে – তাহলে সে অর্থে তুমি যোগ্য পাত্র। আর মনের বিষয়? সেটা তুমি এতদিন ওর সাথে মিশেছ – তুমি জানো না?
- বুঝতে পারিনা মেসোমশাই! সামনা সামনি নিজের কথা বলতে পারিনা – ইগোর ভয়ে। ওর তরফে কিছু আছে কিনা বুঝতেই পারিনি এতদিন।
- তোমাদের রোজ দেখা হয়?
- না।
- তবে কি ফোন কর?
- আমি করি। ও নিজে থেকে কখনও করে না।
- তুমি ফোন করলে গল্প করে?
- হ্যাঁ।
- তবে কিছুদিন না করে দেখো, ওর রিঅ্যাকশানটা বোঝা যাবে।
- অনেকবার এরকম করেছি। ওর কোনও তাপ উত্তাপ থাকে না। যদি অভিমান করেও – ওটা এতটা সূক্ষ্ম যে বুঝতে পারিনা।
- জানো ডাক্তার, যখন সূক্ষ্ম জিনিসে কাজ হয় না তখন স্থুল জিনিসই ব্যবহার করতে হয়। একবার বলে দ্যাখো। না হলে দেখবে, তুমি বলবে ভাবতে ভাবতেই তোমার জিনিস অন্য কারো হয়ে যাবে।
- আপনাদেরও এমন চিন্তা হয়? আগেকার দিনে তো শুনি ছেলেমেয়েরা বিয়ের ব্যাপারে নিজেরা কোনও ডিসিশান নিতে পারতো না। প্রেম করলে করো, বিয়ে করো বাবার কথায়! হাসলো রামানুজ।
- সেটা ঠিক বলেছ ডাক্তার। তবে কি জানো - আগেকার দিনে পুরুষ মানুষ বাপ মার কথা শুনে চলত ঠিক, তবে প্রেমিকা অন্য কারো – এটা মেনে নিতে তাদেরও কষ্ট হতো। হয়তো অনেক সময় তারা কিছু করে উঠতে পারতো না, তবে কষ্ট নিশ্চই পেতো।
- আপনি কী করে জানলেন? আপনারও কি সেম কেস?
- আমার ক্থা পরে বলব। তবে বেদ পুরাণে এমন ইঙ্গিত আছে বইকি! কৃষ্ণের স্ত্রীর নাম জানো?
- না।
- রুক্মিণী, সত্যভামা এসব নাম শুনেছ?
- না।
- সত্যভামা ছিলেন রাজা সত্রাজিৎ এর কন্যা এবং পরমা সুন্দরী। তখন কৃষ্ণ এক প্রবল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সত্রাজিৎ ঠিক করলেন তিনি কৃষ্ণের সাথেই মেয়ের বিবাহ দেবেন। সত্যভামার প্রতি আসক্তি ছিল অক্রূর নামের এক রাজার - এবং শতধন্বা নামের এক যুবকের। সে আবার ছিল বীর কৃতবর্মার ভাই। অক্রূর কৃষ্ণের ভয়ে নিজে সরাসরি যুদ্ধ করল না, কিন্তু শতধন্বাকে তাতিয়ে দিল। সে আক্ষরিক ভাবেই সত্যভামাকে ভালো বাসতো। সে উত্তেজিত হয়ে সত্রাজিৎকে বধ করলো। একে তুমি কি বলবে? এটা কি না পাওয়ার জ্বালা নয়? এরকম আরও অনেক আছে।
- আর মেয়েদের কষ্ট? তাদের প্রেমিক ভিন্ন অন্য কারো সাথে বিয়ে হলে কী হতো – তেমন কিছু কি আছে কোনও পুরাণে?
- কেন থাকবে না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো দ্রৌপদী। অর্জুন দ্রৌপদীকে জয় করেছিল। দ্রৌপদী স্বাভাবিক ভাবেই ওকেই হৃদয় প্রাণ সঁপেছিল। তখনকার দিনের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী দ্রৌপদী। অথচ তাকে তার কৌমার্য প্রথম সঁপতে হলো যুধিষ্ঠিরকে - যে তার তুলনায় অনেক বড়। তার মনোবেদনার কথা উল্লেখ করেছেন মহাভারতের কবি।
- এবার আপনার নিজের কথা বলুন মেসোমশাই।
- ও আর কী করবে শুনে? কবেকার কথা!
- না, তাও বলুন।
- আমার তখন আঠারো উনিশ বয়েস। বি.এ. পাশ করেছি। আমাদের বাড়ীর ঠিক উল্টোদিকে এখন ফ্ল্যাট দেখছ, ওখানে একটা দোতলা ছোট বাড়ী ছিল। আমাদের এই দিকেই ওদের জানালা ছিল। ওই জানলা খুললেই আমার মন চলে যেত - সপ্ত সাগর পার। হলুদ ডুরে শাড়ী পরা এক সদ্য যুবতী যখন মাথার চুলে চিরুনি দিত, মনে হ’ত সন্ধ্যা বুঝি নেমে এসেছে ওখানে। দু একবার চোখে চোখ মিলে যেত যখন, মনে হ’ত এক বিপুল তরঙ্গ যেন বিষ্ফারিত হতে গিয়েও থমকে গেল অজানা কারণে। যারা ভাবে বেশী, তাদের জীবনে আর বলা হয়ে ওঠে না, ডাক্তার! একদিন দেখলাম অচেনা এক লোক এসে নিয়ে চলে গেল আমার স্বপ্নচারিণীকে। দু চার দিন ঘুম এল না। মনে হল মিছিমিছি এ জীবন ঈশ্বর দিলেন কেন? তবে কথায় বলে না, রাত পোহালে শোক পোহায়। অভ্যাস হয়ে গেল সব।
- আর মাসিমা? ওঁর সাথে বিয়ে হল কী করে?
- আরও বছর আটেক পরে – একদিন বাবা এসে বললেন - ফাল্গুনের আঠাশে তোমার বিবাহ। চাইলে দেখে আসতে পারো। তবে ওই দেখাটুকুই হবে। ওখানে আমি কথা দিয়ে এসেছি।
- একেবারে কথা ফাইন্যাল করে এসেছিলেন?
- তখন এইরকমই আকছার ঘটতো। বাবা কাকাদের মুখের উপর এই বিষয়ে কথা বলাকে অমার্জনীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হ’ত। আর যারা এই ধৃষ্টতা দেখাতো – অবধারিইত ভাবেই তারা বাড়ী থেকে ব্রাত্য ঘোষিত হ’ত।
- আপনি কি করলেন? সেজেগুজে চলে গেলেন?
- আবার কি? আমার সাথে প্রায় বাহান্ন বছরের দাম্পত্য ছিল তোমার মাসীমার। তখন ওই ছিল সব। জানালার ওপারের মেয়ে আর উঁকিও দিতো না কোনও দিন।
- ওঁর সাথে আপনার মানসিক নৈকট্য ছিল?
- আমরা ওভাবে দেখতাম না ডাক্তার। আমাদের সময়কার বেশীর ভাগ মানুষের কাছে স্ত্রী ছিল একটি বিশেষ প্রকার জীব। তারা উদয়াস্ত সংসারের কাজ করত, রাত্রে স্বামীর সঙ্গ করতো, ছেলেমেয়ে মানুষ করতো। আমরাও জীবনে স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনও নারীকে ছোঁয়া যায়, ভাবা যায় এমনটা মনেও করতে পারতাম না। আর মন? আমি আমার স্ত্রীর কাছে মানসিক খোরাক কিছু আশাই করতাম না।
- সেটা কি ভালো?
- ভালো খারাপের প্রশ্ন উঠছে না ডাক্তার। ঘটনাটা জানাচ্ছি মাত্র।
- তাহলে মনের খোরাক কি ভাবে পেতেন?
- মনের খোরাক কি স্ত্রীদের কাছেই সবসময় থাকতে হবে ডাক্তার, নাকি থাকা উচিত। তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা বুঝি মন বুঝে প্রোপোজ কর?
- কিছুটা ওই বিষয় তো কাজ করেই।
- তাহলে তোমার আর প্রোপোজ করা হবে না হে ডাক্তার! তুমি তো আজ অব্দি ওর মনই বুঝে উঠতে পারলে না! ছাড়ো ওসব – তুমি বুক ঠুকে বলে দাও। দ্যাখো তোমার মনে সে এত তরঙ্গ পাঠাচ্ছে যখন, তখন তোমাদের মনেরও মিল আছে। শুধু রূপের জন্য যে প্রেম, দেখবে তার মধ্যে হাহাকার থাকে না, বেদনা থাকে না।
- ওখানে কী থাকে?
- ক্রোধ, হিংসা। যেমন অক্রূরের ছিল।
- তাহলে শতধন্বের কি ছিল? সে ও তো সত্রাজিৎ কে বধ করেছিল।
- দেখ ডাক্তার ওটা ঠিক তোমাদের ভাষায় ‘বার খাওয়া বলরাম কেস’; ও আদতে সত্যভামাকে ভালোই বাসতো। যেমন তুমি ভালোবাসো। তোমার বন্ধুটি জানে? কী করে সে?
- সেও ডাক্তার। কার্ডিওলজিষ্ট।
- শোনো তুমি আগে মেয়েটিকে বল। যদি রাজী না হয় – তাহলে বুঝে দ্যাখো – সেটা বাবা-মায়ের খারাপ লাগাকে সম্মান জানানোর জন্য কিনা! তেমন হলে ওর দাদাকে বল, সরাসরি বাবাকেও বলতে পারো।
- কিন্তু বিয়ে যে ফাইনাল হয়ে গেছে!
- বিয়ে তো হয়ে যায় নি। বলেই দ্যাখো না। আর যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সেও কৃষ্ণ-বাসুদেব নয় যে তোমাকে বধ করবে। দেরী ক’রো না। আজই বল। দ্যাখো, হয়তো মেয়েটি তোমার বলার প্রতীক্ষায় বসে থেকে থেকে এতদিনে হাল ছেড়ে রাজী হয়েছে। বা হয়তো সেও তোমায় বলতে চেয়েছে, তুমি শুনতে পাওনি।
- ঠিক আছে। আজ এখান থেকে ফিরেই বলব। কিন্তু আপনি একটা কথা বলুন তো মেসোমশাই, আপনি নাকি সারাদিন মাসিমার ফটোর দিকে চেয়ে অনবরত বকতে থাকেন?
- কে বলল? বৌমা?
- হ্যাঁ।
- কী করব বল! আমি সারাদিন আর কার সাথে কথা বলি? আমার কাছে সারাক্ষণ যে মেয়েটি থাকে – তার সাথে কি আর কথোপকথন হয়? সে এসে কিছু রুটিন কথাবার্তা বলে আমার সাথে। মেসোমশাই কেমন আছেন? চা দেবো? স্নান করবেন এখন? এই সব। সারাদিন যা কথা জমে, বলব কার সাথে?
- কিন্তু একপাক্ষিক কথা বেশীক্ষণ চালান কি করে? কেউ একটা জবাব না দিলে কি কথা বলা যায়? না কি কনটিনিউ করা যায়?
- কেন তোমার মাসিমা উত্তর দেয় তো!
কপালে ভাঁজ পড়ল রামানুজের। এই তো পাগলামির লক্ষণ! সে আরও উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল – কী রকম উত্তর দেন।
- ডাক্তার, তুমি বুঝি ভাবছো – এই তো চেনা ছকে পড়ে গেছে লোকটা? আরে বাহান্ন বছরের সংসার ছিল আমাদের। আমি কী কথা বললে সে কী বলতে পারে - আমার মনে তো সব গাঁথা হয়ে আছে। মৃত মানুষ আবার কথা বলবে কি? ওর মুখের কথাগুলোও আমিই বলি – একই সঙ্গে আমার কথাও। আর এরা ভাবে বুড়োর মাথার ঠিক নেই।
- তাহলে কাল রাতে এত অস্থির ছিলেন কেন আপনি? ঘুমের মধ্যে নাকি চিৎকার করছিলেন? আবোল তাবোল বকছিলেন?
- কে বলেছে? ঝর্ণা?
- ঝর্ণা কে?
- ওঃ তুমি জানোনা বুঝি! ঝর্ণা হ’ল আমার রাতের আয়া।
- আপনি কি কাল কোনও স্বপ্ন দেখেছিলেন?
- স্বপ্ন তো আমি রোজ দেখি। কত রকমের স্বপ্ন – লাল-নীল-হলুদ।
- মানে?
- মানে তুমি বুঝবে না ডাক্তার। তুমি জানো – স্বপ্ন কয় প্রকারের?
- জানি একপ্রকার – ডে ড্রিম, লুসিড ড্রিম, নাইট মেয়ার, রেকারিং ড্রিম – প্রোফেটিক ড্রিম- এইরকম কিছু ভাগ আছে।
- তোমরা তো স্বপ্নের প্রকৃতি অনুযায়ী ভাগ করেছো। জানো আমাদের শাস্ত্রে স্বপ্নকে কি ভাবে বলেছে?
- বলুন, শুনি।
- স্বপ্ন সাত প্রকার। দৃষ্ট – মানে আমরা যা চাক্ষুষ করি তাকেই স্বপ্নে দেখা। অনুভূতি – মানে আমরা যা অনুভব করি তাকে স্বপ্নে দেখা। কল্পিত – যা আমরা কল্পনা করি, প্রার্থিত – যা আমরা পেতে চাই। আর দুপ্রকার আছে – ভাবিক এবং দোষজ- এগুলি রোগের কারণে হয়।
- কালকের স্বপ্ন আপনার কেমন ছিল?
- কালকে আমি মৃত্যুকে দেখেছি জানো?
- মৃত্যুকে দেখা যায়? রামানুজ কৌতুহল দেখালো।
- দেখলাম তো। জানো ডাক্তার – বেলা এবার বোধহয় ফুরোল হেথাকার!
- এভাবে বলছেন কেন? কী এমন বয়স আপনার?
- তুমি জ্যোতিষ মানো?
- না। বুজরুকি এসব।
- জানো, আমি মানি। আমাকে ছোটবেলায় এক জ্যোতিষ আর্যাকুষ্ঠী বানিয়ে দিয়েছিলেন। ওতে লেখা আছে আমি চুরাশি বছর পর্যন্ত বাঁচবো। ওঁর সব কথা অভ্রান্ত ভাবে মিলে গেছে আমার জীবনে।
- এই জন্যই আপনি এসব স্বপ্ন দেখছেন। মাথাতে ওটা গাঁথা হয়ে গেছে আপনার।
- না হে ডাক্তার। আমি কি মৃত্যুকে ভয় পাই? আমি তো চাই এবার আমার আত্মা খাঁচা ছেড়ে উড়ে যাক।
- আপনার কথা মতো এটা তো প্রার্থিত স্বপ্ন।
হাসলেন নিখিলেশ। রামানুজ বলল, আমি একটা অল্প পাওয়ারের ওষুধ লিখে দিচ্ছি – আপনি খান আজ থেকে।
- আবার ঘুম পাড়ানি?
- না না, এতে বেশী ঘুম হবে না। আপনার রাতের অস্থিরতাটা কাটবে।
- তুমি আবার কবে আসবে ডাক্তার? তুমি তো আমার দইওয়ালা যে গো! মুক্তির আলো নিয়ে আসো তুমি।
- দিন সাতেক বাদে আসি ?
- কাল পরশু আসতে পারবে না? তোমার অনিতা বৃত্তান্তটা শুনে যেতে চাই।
- আচ্ছা দেখি। আসলে আমাকে কল না দিলে শুধু শুধু আসি কী করে? আপনার ছেলে বৌমা কি ভাববে?
- আচ্ছা। এসো আজ।
রামানুজ কিছুটা ভারাক্রান্ত মন নিয়েই বিদায় নিল আজ। নানান রোগী সে দেখে - কিন্তু নিখিলেশবাবুকে কোনও চেনা ছকে ফেলা যাচ্ছে না কোনও মতে। সে নিজেও এই দুদিনেই নিখিলেশ বাবুর প্রতি অদম্য এক টান অনুভব করছে। নীচে গিয়ে নিখিলেশ বাবুর ছেলেকে সে জানালো – ‘একটা নতুন ওষুধ দিয়েছি আজ। আজ রাত থেকে একখানা করে ট্যাবলেট খাওয়ালেই হবে। কাল কেমন থাকেন জানাবেন আমাকে। পারলে পরশু এসে দেখে যাবো’।
🍂
পরের দিন সকালেই রামানুজ খবর পেল নিখিলেশের ভুল বকা আরও বেড়েছে। কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। ওঁর ছেলে বৌমা স্থির করেছে কোনও নার্সিংহোমে ভর্ত্তি করে দেবে। রামানুজের নাম করছেন নাকি বারবার। যদি সে এসে একবার দেখে যায়। রামানুজ কোনও রকম সকালের ক্লিনিক সামলে বেলা দেড়টা দুটোর সময় এসে পৌঁছলো নিখিলেশের বাড়ী। দেখল ওনার ঘরে সবাই ওঁর বেডের সামনে জড়ো হয়েছে। ওকে দেখে হালকা হাসলেন নিখিলেশ। কাছে আসতে ইশারা করলেন। বললেন – ‘একটু একা কথা বলব তোমার সাথে’।
রামানুজ সবাইকে অনুরোধ করল যেন তাঁরা একটু বাইরে যান।
- বলুন মেসোমশাই।
- কী হলো? বলেছো?
মুচকি হাসলো রামানুজ।
- কী হলো ডাক্তার? পাখী খাঁচায় বসতে রাজী হয়েছে তো?
- হ্যাঁ মেসোমশাই।
- জানি রাজী হবে। জানো ডাক্তার – এত বড় আকাশ, তবু পাখী এসে খাঁচাতেই বসতে চায়। জানতো কত পাখী – এখন আকাশে। ওই হলুদ বদ্রী পাখীটাও এসেছে যে গো।
- কোন বদ্রী পাখীটা?
- কেন মনিলাল বলেনি তোমায়?
- মনিলাল? সে কে?
- মনিলাল, যে বদ্রীটা উড়িয়ে দিল!
রামানুজ বুঝলো নিখিলেশ প্রলাপ বকছেন। ও আলতো করে ওঁর কাঁধটা ঝাঁকিয়ে বলল, কোন বদ্রীর কথা বলছেন মেসোমশাই?
- ওই যে – আমাদের বাড়ীর উল্টোদিকের খাঁচার মধ্যে থাকতো হলুদ ডোরা – মস্ত বড় ডানা তার। চিরুনি দিতে দিতে উড়তে চাইতো! সে এসেছে তো!
- কোথায়?
- এই তো আমার মাথার কাছে। তুমি দেখতে পাচ্ছো না? জানো তো ওর মস্ত ডানাজোড়া কাটা পড়েছে বহুদিন। সেই যে উড়তে গেল – তখন থেকেই। তোমার মাসিমা - তিনিও মস্ত পাখী হয়ে উড়ছিলেন আকশে। এখন এলেন এই মাত্র আমায় ডাকতে। ডাক্তার এক কাজ করবে?
- বলুন।
- ওই দ্যাখো – আমার আলমারীর মধ্যে একটা হলুদ পাঞ্জাবী আর তার সাথে একটা পায়জামা আছে পরিয়ে দেবে? কাল থেকে ঝর্ণাকে বলছি – ও কিছুতেই দিচ্ছে না। বলে নাকি শুয়ে আছেন – ভালো জামাকাপড় পরে কী হবে?
- আপনিই বা পরতে চাইছেন কেন?
- সক্রেটিস মৃত্যুর সময় কী করেছিলেন জানো?
- না।
- উনি তখন তার শিষ্যদের বলেছিলেন – ‘আমাকে নতুন জামা কাপড় পরিয়ে দাও।‘ তবেই না তিনি মৃত্যুকে বরণ করতে পারবেন।
রামানুজ পরম যত্নে তাঁকে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে দিল। নিখিলেশ বললেন – জানো তো এবছরের জন্মদিনে বৌমা দিয়েছিল এটা। রেখে দিয়েছিলাম আজকে পরবো বলে।
নিখিলেশ আবার বললেন – ওখানেই দ্যাখো একটা লাল রঙের ভেলভেটের প্যাকেট আছে। ওটাও নিয়ে এসো।
রামানুজ আদেশ পালন করলো।
নিখিলেশ একটু ইতস্তত চেয়ে ওর হাতটা ধরে বললেন – এর মধ্যে একটা আংটি আছে, তোমার মাসীমাকে বানিয়ে দিয়েছিলাম। পুরোনো ডিজাইন হয়তো তোমার পছন্দ হবে না। ভেবেছিলাম – নাত বৌকে দেব। কিন্তু এখন আমার ইচ্ছা – তুমি যদি অনীতাকে এইটা পরাও আমার ভালো লাগবে।
- এ আবার কেন মেসোমশাই? আপনি নাত বৌকেই দিয়ে যান। ওটা ওরই প্রাপ্য।
- তুমি আমার কথা রাখবে না দইঅলা। জানো তো মস্ত আকাশ জুড়ে আজ খালি হলুদ আর হলুদ রোদ। মেঘ গুলো সব পাখিদের ডানায় ধাক্কা খাচ্ছে আর সরে সরে গিয়ে নালিশ জানাচ্ছে মনিলালকে।
রামানুজ বুঝলো আবার অন্য জগতে চলে যাচ্ছেন নিখিলেশ। ও বুঝে উঠতে পারলো না কি করা উচিৎ। নিখিলেশ এখনও ওর হাতটা ধরে আছেন। ও ধীরে ধীরে হাতটা ছড়িয়ে নিতে গেল। আবার ঘোর কাটলো নিখিলেশের। তিনি বললেন ‘যাও। এটা তোমার ব্যাগে পুরে নাও। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। তুমি এবার যাও ডাক্তার। আমি একটু ঈশ্বরকে প্রণাম করে নিই’।
রামানুজ দেখলো – কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে কপালে ছোঁয়ালেন নিখিলেশ। মনে মনে কী সব বিড়বিড় করলেন। হঠাৎ করে হাত দুটো শিথিল হয়ে পড়ে গেল পাশে। রামানুজ পরিষ্কার অনুভব করলো – কিছু একটা বেরিয়ে গেল নিখিলেশের দেহ থেকে। সে এতদিন হাসপাতালে বহু মৃত্যু দেখেছে – কাছেও থেকেছে সে সময়। এমন অনুভূতি তার হয়নি কখনও। টর্চ দিয়ে চোখটা দেখলো সে - পিউপিল ডাইলেট করে গেছে। আর পালস নেই। এই স্থূল শরীর ছেড়ে সূক্ষ্ম শরীরের খোঁজে বের হয়ে পড়েছেন নিখিলেশ। তাঁর সঙ্গে আজ কোন পাখি, কে জানে?
দেহে অস্মিন যথা দেহে কৌমারং গৌরবং জরা।
তথা দেহান্তর প্রাপ্তি ধীরঃ তত্র নমুহ্যতি।।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments