জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /পঁয়তাল্লিশ তম পর্ব /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় 
পঁয়তাল্লিশ তম পর্ব 
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী 


যে কোন ঘটনা,তা সে যত তুচ্ছ অথবা খুব গুরুত্বপূর্ণ; যাই হোক না কেন,পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে তার কিছু প্রভাব পড়ে থাকেই।পরপর দুই বারের মহামারী বন্যা এবং তৎপরবর্তী সমস্যায় স্বাভাবিক ভাবেই এলাকার তথা সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের সমুহ ক্ষতি হয়েছিল সেসময়।চাষবাসের জমি জলে ডুবে ফসলের অভাবের জন্য সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়া,খাদ্যাভাব,ঘরদোরে ফাটল ধরা, মাঠেঘাটে সাপখোপের উপদ্রব,অকাল মৃত্যু,সঠিক চিকিৎসার অভাব… এসবই গ্রামীন অর্থনীতির মূলে আঘাত করেছিল।অভাব তো সদাসঙ্গী সাধারণ মানুষের, কিন্তু সেই প্রথম বোধহয়,অভাবের সঙ্গে দূর্দশার যোগ হয়েছিল।পরিস্থিতি এমন যে,দুবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পাওয়াটাই সৌভাগ্য বলে মনে হতে লাগলো অনেকের।
শহরের মানুষেরা রুটি খেতে শিখলেও গ্রামেগঞ্জে তখনও ছাপোষা মানুষজন চাষের চালের ভাত,মুড়ি, পান্তা এসবে অভ্যস্ত ছিল,বেড়ায় লতিয়ে বেড়ে ওঠা লাউ-কুমড়ো, পুঁইশাক তাতে সঙ্গ দিতো। সেই প্রথম গম,সুজি, আমেরিকা থেকে সাহাজ্য পাঠানো সোয়াবিনের গুঁড়ো, পাঁউরুটি গ্রামের মানুষ খেতে শিখল।
আসলে বন্যা যে আগে কখনো হয়নি,এমনটা তো নয়,ফিবছরেই হয়তো অল্পস্বল্প হো’ত। এবং নদীপাড়ের পালের জমিতে ফসল তুলে মানুষজন সে ক্ষতি খানিক পুষিয়েও নিত।তবে সেইবারেই প্রথম দীর্ঘদিন জল জমে থাকার কারণে,সব পচে হেজে একসা হয়ে যায়, মাঠের পরে মাঠ নিষ্ফলা,ধানই হয়নি। কোজাগরী পুজো তো বাঁধেই কেটেছিল সেবছর।শীত পড়তে,জল কমতে সবাই ঘরে ফিরেছিল। ফলে,বাইর লক্ষ্মীপুজোতেও সেবার ধান্য গুচ্ছ পাওয়া  যায়নি, সেই প্রথম;চারপাশে অনেক খুঁজেও।
ধান চাষই করতে পারা যায়নি,তো ধান্যগুচ্ছ! 
মনে পড়ে,আশ্বিন সংক্রান্তির দিন, সকাল হলেই জ্যাঠামশাই স্নান পুজো পাঠ সেরে,মজুর জুটিয়ে নলখাগড়া পুঁততে যেতেন জমির ধারে।সেদিনটি নল সংক্রান্তি মানা হতো যে!
এখনও কি হয়!এবছরও হচ্ছে!
অবচেতনের ওপার থেকে কে যেন ডেকে বললেন তাঁকে,
-’পিসিমা!ও পিসিমা!নলের পুজোর জিনিসপত্রগুলো কোথায় রেখেছেন? আমরা যে খুঁজে পাচ্ছি না!’
লাল টুকটুকে সিমেন্টের বারান্দাময় তখন আশ্বিনের রোদ চড়াই পাখির মতো তিড়িং বিড়িং খেলছে। এদিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বৃদ্ধার মনোগহনে উড়ছে অন্য ছবি।
এক কিশোরী মাটির দাওয়ার এককোনে আল্পনায় আঁকছে ধানছড়া,পদ্মলতা,লক্ষ্মীর পা…
তার জ্যাঠাইমা স্নান সেরে এলোচুলে ঘোমটাখানি টেনে হামারতলা থেকে ধামায় করে বুনো ওল, কেশুতের শেকড়, রাই সরষে, হলুদ, নিম ও পলতার পাতা, চালের খুদ,গোটা ডালের দানা,দূর্বাঘাস এবং আরও যেন কি কি সব জুটিয়ে নিয়ে এলেন,স্মিত হেসে বলেন তাকে,
-’শিখে নে মা। এভাবেই ধামা সাজিয়ে আজকের দিনে জমির মালিককে জমিতে পাঠাতে হয়।’
-’কেন গো জ্যাঠাইমা?’
-’ওরে মেয়ে! আজ যে নল সংক্রান্তি। আশ্বিনের শেষদিনে,আমনের ক্ষেতে ধানের দুধে আজ থেকে ভর লাগে,গাছপোয়াতির তাই আজ সাধ রে মা! ঘরে ঘরে ধানে ভরে যাবে ,নলখাগড়ার মতো বাড়-বাড়ন্ত হবে ফসলের,পুজো করলে,সাধ দিলে তবেই তো!’
তখনও সাধ ব্যাপারটা ততখানি বোধগম্য হয়নি,তবে টের পেয়েছিল, ফসলের আকাঙ্ক্ষা,পরিজনের কল্যাণকামনার নামই পূজা; এবং সেখানে নারীপুরুষ উভয়েরই সমান দায়, সমান অধিকার;শাস্ত্রের অন্তত তেমনটাই বিধান।জ্যাঠাইমা অনর্গল বলে চলেন, কিশোরী শোনে অবাক বিস্ময়ে, 
-’ঘরের মেয়েরা সাজিয়ে দিলে কর্তা মাঠ পারে গিয়ে নলগোড়া শালুক ফুলের ডাঁটায় জড়িয়ে পুঁতে দেবেন,চাষীবৌ পরপর তিনবার ছড়া কাটবে,

-”অন-সরিষা, কাঁকুড় নাড়ি,/ যা-রে পোক ধানকে ছাড়ি/এতে আছে শুকতা,/ধান ফলবে গজ মুক্তা।/এতে আছে কেঁউ,/ধান হবে সাত বেঁউ।”
বলতে বলতে আসন্ন তৃপ্তিতে মাতৃ মুখে দিব্য বিভা…
-’তাই!কি মজা!কি মজা! আমিও যাবো জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে!’

🍂

বলে ওঠে বালিকা তারা।
-’না মা। মেয়েদের  কাজ বাড়ি রক্ষা।বাড়ি থেকেই ধান ডাকি আমরা।বড়ো হলে…’’
বলতে বলতে চলে গিয়েছিলেন ব্যস্ত গৃহিণী আবার সেই হামারের তলায়,ঘরের নারকেল-সুপারীর সঙ্গে সঙ্গে যেখানে সারি সারি হাঁড়িতে  বছরভ’র গচ্ছিত থাকতো তেঁতুল,আমচূর, কাসুন্দি,ডালকলাই,তিল,তিসি, সর্ষে আর এসব ঠাকুর-ঠুকুরের তৈজসপত্র। গৃহিণীর একান্ত সংসার!

জ্যাঠাইমার প্রয়াণের পরে,বিরজার হাতেই এতোদিন ছিল সেসব রক্ষার দায়।বড়োবৌদিদি নেই ,মেজবৌদিদি কখনোই ততটা দক্ষ সংসারী নয়,আর ছোটটি তো চিরকালের কনেবৌ;বরের কাছে কলকাতায় থাকাতেই তার স্বস্তি। অগত্যা…
এবছর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় হয়েছে ঝামেলা;বাড়ির কেউ কিছু তেমন জানেনা,এদিকে বিধি পালনের দায়।মনের আনচান ভাব যেন ইথার তরঙ্গে সংবাহিত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো অনুজা বৌদির মনে।প্রায় পনের বছরের বিবাহিত জীবনে এবাড়িতে এসে ইস্তক সে দেখেছে পিসিমাকে পুজো আচ্চার দিনে এভাবেই উপচার সাজাতে। কি মনে হতে সে আবার ফিরে গেল হামারের তলায়,ওর বাবার বাড়ির দেশে যাকে মারাই বলে… উবু হয়ে বসে খানিক এদিকে ওদিকে খুঁজতেই পেয়ে গিয়েছিল কাম্য সম্পদ;বুনো ওল, কেশুতের শেকড়, রাই সরষে, হলুদ, নিম ও পলতার শুকনো পাতা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর অসুস্থ বৃদ্ধা ছেলেমানুষ বৌদির আদলে আঁকতে লাগলেন তাঁর জ্যাঠাইমার ছায়া.…
এই হয়তো ধ্রুবক নারী জীবনের।জন্ম হয় একঘরে,বিবাহ অন্যত্র। সারাজীবন সে ঘরের কল্যাণ সাধন, সবশেষে কলন্দরী ফিরে যাওয়া… অন্য কেউ এসে আবার শুরু করে সেই অলঙ্ঘিত খেলা।চিরায়ত কাল বয়ে যায় একের পরে একে,কেউ যায় কেউ আসে।প্রবাহ অবিরল,তার গতি নিত্য বহমান।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments