জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত /অফিস খোলার দিন। /পর্ব ১

চিত্র-মণিদীপা দাস

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
অফিস খোলার দিন। পর্ব ১

ধাক্কাটা জোরেই লাগল। একেবারে আকস্মিক। দুজনের হাতে দুটো মোবাইল। ছিটকে পড়ে গেল দুটোই। সজল চটপট কুড়িয়ে নিল নিজেরটা।কাঁচটা ছাঁটাই হওয়া ওয়ার্কারের বাবার চশমার মত ঝাপসা। টিমটিম করে দেখা যাচ্ছে ভেতরে লাল নীল আলোর গোল চৌকো ছবি। ছোঁয়া যাচ্ছে না। রুমালে মুড়ে সাবধানে পকেটে রাখার পরে একটা নিঃশ্বাস পড়ল। আবার কত টাকা যাবে কে জানে। কুসুম বলেছে অফিস জয়েন করেই ফোন করতে। এমন ভাঙল যে নম্বর টাইপ করাও যাচ্ছেনা। কুসুম বসে থাকবে। চিন্তা করবে। 
দেবোত্তম ফোনটা আলগোছে তুলে নিয়ে পকেট থেকে বার করল টিসু। আর এক পকেট থেকে বেরোল মিনি স্যানিটাইজার। যত্ন করে আলতো ঘষে পরিষ্কার করতেই ফুটে উঠল লেখা, রোজির। ‘আমার একটা পার্টি আছে। ফোন করো না।‘ 
টুক করে একটা হাত জোড় ইমোজি পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। এজন্যেই এই ফোনের এত দাম। এত জোরে পড়লেও একটা আঁচড় পর্যন্ত লাগে নি। 
ট্রেনটা এসে দাঁড়ালো আর কতক্ষণই বা দাঁড়াবার সময় তার। ভুবনজাগানো বাঁশী বাজিয়ে চলতে শুরু করতেই ডাবওলা, ডটপেন, মোবাইল কেস, ঝাল মুড়ি সবাই টকাটক উঠে পড়ল ট্রাপিজ আর্টিস্টের মত। সজল দুবছর বাড়ী বসে। দাদার দোকানে বসে লম্বা হাতা দিয়ে ডাল চিনি তুলে ওজন করে আর এর ওর বাড়ীর দেওয়াল তুলে, ছাদ ছাইয়ে কোনমতে করোনা কালটা কাটিয়েছে। বিক্রি হয়ে গেছে দু বিঘা তিনফসলা জমি। ওজন কমেছে আট কেজি।ট্রে নে চড়ার অভ্যেস চলে গেছে। হঠাৎ দৌড় লাগাতে হবে খেয়াল হয় নি। 


দেবোত্তম ট্রেনে চড়ার লোক না। গাড়ী চালিয়ে ঘোরাফেরা করত বেঙ্গালুরুর রাস্তায়। আউটার রিং রোড নাইস রোড দিয়ে সাঁই সাঁই চলত ইএম আই দিয়ে কেনা জাপানী গাড়ী। দু বছর এই মফস্বলে শ্বশুর বাড়ীতে বসে বসে ওরও হাতে পায়ে খিল ধরে গেছে। আনন্দেই কেটেছে। কে জানে? শ্বশুরের ট্রাকের ব্যবসা। সব গাড়ী বন্ধ হলেও ভাইরাস ট্রাক আটকাতে পারে নি। শুদ্ধভাষায় যাকে বলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, তার জন্য পথ খোলা। খাও পিও জিওর রাজত্বকালে অবারিত ইন্টারনেট। তবু আজ ট্রেনে বাধ্য হয়েই চড়া। সব ফ্লাইট ফুল। অফিস থেকে হঠাৎ নোটিস এসেছে জয়েন করার।প্র ভাবশালী শ্বশুরের প্রভাবে ভি আই পি কোটায় ট্রেনে পাওয়া গেছে এসি টুটায়ার। হাওড়া যাবার সহজ উপায় এখন এই বর্ধমান লোকালে চড়ে বসা। এত তাড়াতাড়ি দুম করে যে লোকাল ট্রেন ছাড়ে সেটা তার অভিজ্ঞতায় অনেকদিন ছিল না। 
ট্রেনে উঠে খালি সীট দুটো জানলার ধারে মুখোমুখি। এই ভোরবেলা এখনও নিত্যযাত্রীর ভীড় নেই। করোনা প্রায় নিভুনিভু। কিন্তু বাজার মন্দা। যারা সকালে উঠে বিভিন্ন বাজারে পৌঁছয় তাদের সংখ্যা কম। 
বসে পড়ে দুজনেরই খেয়াল হল সরি বলাটা হয় নি। দুজনে মুখ তুলে দুজনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল কিছুক্ষণ। দেবোত্তমই বলল,
-সরি। দেখতে পাই নি। হঠাৎ ছেড়ে দিল গাড়ীটা
-আরে না না আমারই দোষ। দেখা উচিত ছিল। আপনার ফোন ঠিক আছে? আমি খুব লজ্জিত বোধ করছি। 
গ্রামের লোকের সাধু বাংলা বলার অভ্যেস আছে। 
এরপরে রাগ দেখানো মুস্কিল। দেবোত্তমের শ্বশুর যেমনই হোক, সে সফটওয়ার ইন্জিনীয়ার, শান্ত হয়ে কোড লেখে। প্রায় মহাভারত লেখার মত ধৈর্য লাগে। আয়নায় দেখলে মনে হয় একটা শূঁড় ও বোধহয় গজাবে শীগগিরই।
-না ঠিক আছে। তোমার, মানে আপনারটা?
-কাঁচটা গেছে। ও ঠিক আছে। চালিয়ে নেব। 
সজল মনে মনে হাসল। ওর জীবনটাই এমন ভান্গা মোবাইল দু বছর। চালিয়ে নিচ্ছে। কি আর করা?
কিছুক্ষণ চুপ। টাঁ আওয়াজ করে গাড়ী নয় যেন ইলেকট্রিক কারেন্ট যাচ্ছে। নিমেষেই শক্তিগড়। ঘটাং ঘট করে হঠাৎ থামে। চুপচাপ স্টেশন। এই আশ্বিনের হাল্কা জল মেশানো নরম হাওয়া আনমনা রোদ্দুরের সংগে গল্প করছে। দেবোত্তমের মন একটু হাল্কা হয়। একটা কাক এসে ছোঁ মেরে চাওলার একটা বিস্কুট নিয়ে যায়। বড্ড সাহস। খেয়াল করলে বোঝে চা ওলা ডেকেই দিয়েছে বিস্কুট। যেন পোষ মানা অনেক দিনের কাক। ট্রেন ছেড়ে দেয়। 
সামাজিক স্তরভেদের নিয়মমত দেবোত্তমই কথা পাড়ে। সজল উত্তর দেয়। 
-যা করোনা গেল। দেশটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। কেউ মানে করোনায় আপনার কারো-
ম্লান হাসে সজল। 
-না। শীতলা মার দয়ায কেউ গত হন নি। অসুখ ধরেছিল। এক ধার থেকে সব জ্বর। সেরে গেছে শেষপর্যন্ত। 
-টেস্ট করান নি?
-সে অনেক ঝামেলা। পয়সা লাগে প্রাইভেটে। আর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে লাইন মারপিট পার্টির কাগজ দেখাও। 
-সে কি! টেস্ট করানো কিন্তু উচিত ছিল। ভাগ্য ভালো কারো তেমন বেশি কিছু হয় নি। আমার তো..
-কেউ গত হলেন নাকি?
-হ্যাঁ। যোধপুর পার্কে আমার ভগ্নিপতি ছিলেন। হঠাৎ। যাক সে কথা। তা এতদিন যে সব বন্ধ ছিলো, আপনাদের আর্থিক কোন অসুবিধে…
সজল দেবোত্তমের মুখ দেখে বুঝলো তার কোন অসুবিধে তেমন হয় নি। ওর যে কারখানা বন্ধ, দুবছর কিভাবে কেটেছে সেটা জানাতে ওর সম্মানে বাধল। কথা ঘুরিয়ে দিল সজল,
-ঐ আর কি। তেমন কিছু না। কাজ বন্ধ। মাইনে পাইনি। এটা ওটা করে মানে চালিয়ে দিয়েছি স্যার। আর আজতো একটা বিশেষ দিন। আনন্দের। কষ্টের দিন শেষ হতে চলেছে।
সজলের মুখ উদ্ভাসিত। আনন্দ হলে সবাই চায় সেটা ভাগ করতে। টাকা হলে অন্য কথা। 
-আরে বাবা তাই নাকি? কি ব্যাপার। 
-কারখানা খুলেছে। আজ আমাকে জয়েন করার জন্য ফোন করেছে। 
-ফ্যানটাস্টিক। দারুণ ব্যাপার। তোমাকে তাহলে আমার সিক্রেটটা বলি। আমারও অফিস খুলে গেছে। আমাকেও ডেকেছে জয়েন করার জন্য। 
দুজনের বয়সই আঠাশ থেকে তিরিশ।  তবু সজল দিব্যি স্যার বলে দেবোত্তমকে। দেবোত্তম আপনি থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামে। ওকে তুমি বলে অনায়াসে। 
-বাঃ বাঃ খুব ভালো। ঠাকুরের দয়া। সত্যিই ভালো দিন। আপনারও জয়েন আমারও জয়েন। 

বার বার কপালে হাত ঠেকিয়ে অদৃশ্য কোন শক্তিকে কুর্ণিশ জানায় সজল। দেবোত্তমের একটু গাটা সিঁটিয়ে যায়একটা মজুর তার মত একজন সফটওয়ার এক্সপারট সিটিসি ৪০লাখ, চাঁদের আলোয় কাজ করে আরও কুড়ি, তুলনাটা ঠিক.. তবু একটু শুকনো হাসে। ওর ফোনটা ভেঙে একটু বিবেক দংশন তো হচ্ছে। 
-সত্যিই শুভ দিন বলা যায়। আপনি কি পুজো টুজো দিয়ে বেরিয়েছেন?
-আমি না। আমার বৌ কিসব করে এই ফুল গুলো দিয়েছে, আর কপালে টিপ। বারণ করলাম। 
সজল সলাজ হয়। কুসুমটা যে কি! 
দেবোত্তমের খেয়াল হল বেরোবার সময় রোজি ভীষণ ব্যস্ত ছিল ইন্স্টাগ্রামে সেলফি আপলোড করতে। আসল নাম শ্রীমোহিনী। ইনস্টাগ্রামে হয়ে গেছে রোজি। এখন ঐ ডাকেই শুধু সাড়া দেয়। শুধু হাত নেড়ে বলেছিল ঠিক আছে। মাছি তাড়াবার ভংগীতে। 
যতীন দাস বিদায় হলো। স্বদেশ রৈল পড়ে। বাজখাঁই আওয়াজ। 
হঠাৎ কখন যে এই বিখ্যাত বাদাম বিক্রেতা বৈঁচি স্টেশনে কামরায় চড়ে বসেছে, পিলে চমকানো গানে কামরায় সব্বাই নড়ে চড়ে বসে। 
একজন প্রতিবাদ করে। এটা কি ভুলভাল গান ধরছ বাদামদাদা। তোমার ঐ ভাইরাল গানটার কি হল?
বাদামদাদা গম্ভীর মুখে উত্তর দেয় 
-ও গানটা কপি রাইট হয়ে গেছে দাদাগো। আর গাইতে পারবো না ট্রেনে ঘুরে ঘুরে। এই গানটা খারাপ লাগলো? আমার বাপ এই গান গেয়ে ৩০ বছর পেন আর পেলাস্টিকের খেলনা বেচেছে। 

আবার গান ধরে । পাবলিক উসখুস করে। উপোস করে মরেছিল লোকটা তাকে নিয়ে গানের কি আছে। না খেয়ে মরাটা এই করোনার যুগে নতুন কিছু নয়। 
-আমার কারখানায় তিনজন সুসাইট। ৫ জন না খেতে পেয়ে কচুসেদ্ধ আর গেঁড়ি সেদ্ধ খেয়ে মারা গেছে। 
সজল সংবাদ পাঠের মত বলে। 
দেবোত্তমের কানে যায় না কথাটা। এত গোলমাল বেসুরো গান, ও জানলা দিয়ে চোখ মেলে দেয়। বাংলার শ্যামশ্রী কাজলও চোখ মেলে তাকে দেখে। বাইরেটা ঠিক সোজা হুসহুস করে পিছনে পড়ে যায় না, কেমন গোল বায়স্কোপের মত ঘুরতে ঘুরতে অদৃশ্য হয়ে যায়, ওর বেশ লাগে। 

🍂

-আমি ফিটারের কাজ করি। বঙ্গেশ্বরী আয়রন ওয়ারকস বেলিলিয়াস রোড। এখন কিছুদিন হাপ মাইনে দেবে বলেছে। কম্পানির ব্যবসা ডাউন। তবু সংসারটা তো চলবে। বোনটা ইস্কুল ছেড়ে প্রধানের বাড়ী কাজ ধরেছে। শম্পাকে আবার ইস্কুলে দেব। মিডডের খাবার পাবে। এরপর সবুজ সাথীর সাইকেল পাবে। এখন হাফ মাইনেতেই চলুক। ৮০০০ টাকা দেবে বলেছে। আপনারা ভালো কাজ করেন নিশ্চয় ভালোই মাইনে পান। 
শেষ বাক্যটা আর সজল বলে না। কি জানি কি ভাববে। উনি তো মনে হয় টিসিএস মিসিএসে কাজ করেন। কম্পিউটার নিশ্চয়ই। যদিও সেটাও একটা মেসিন। ওরও চালাতে হয় মেসিন। তেল কালি লোহার ছাঁট হাত ধুয়ে বাড়ী গেলে কে বলবে সারাদিন ভুত হয়ে ছিল। 
সজল খেয়াল করে দেবোত্তম বাইরে তাকিয়ে আছে। ওর কথা শুনছে না। হঠাৎ দুম করে একটা অনভিপ্রেত প্রশ্ন করে ফেলে। 
-আপনার ফোনটা অনেক হাড। ভাঙলো না। অনেক দামী না? কি ওটা, সামসুল?

ফোন শুনে দেবোত্তমের টনক নড়ে। পাড়াগাঁর লোক বড্ড গায়ে পড়া হয়। ও তাড়াতাড়ি হাত থেকে পকেটে চালান দেয় ফোনটা। শুকনো স্বরে বলে,
-না সামসুং না। এটা আমেরিকার ফোন। চীনা মাল হলে কি আর থাকত? তোমার ফোনের মত হাল হত। 
দাম অনেক। অফিসের কাজেও লাগে। চক্ষুলজ্জায় দামটা আর বলে না। না বলার একটা যুক্তিও খাড়া করার চেষ্টা করে, সজলের এক বছরের হাফ মাইনের সমান ফোনের দাম। সেটা শুনে যদি আবার বায়না করে আমার ফোনভাঙার খেসারত দিন। শ্বশুর মশায়ের ছাতা থেকে দূরে। তেমন কিছু হলে কেস ম্যানেজ করতে পারবে না।
দেখতে দেখতে ব্যান্ডেল জং। জংধরাই বটে। ভাঙা চোরা জিনিষ, গিজগিজ করছে লোক। হুটোপুটি করে লোক উঠতে থাকে। প্রথমে রিফিউজির মত মুখ করে সীট খোঁজে, তারপর গ্যাঁট হয়ে জমিদারি খুলে বসে। ধপাধপ তাস খেলতে শুরু করে। আগে টাকা দিয়ে খেলার এত চল ছিল না। এখন টিভিতে দিনরাত পোকারবাজী দেখে দেখে সবাই টাকার বাজী ধরে খেলে। তখন মনে থাকে না গ্যালপিং ট্রেনের মত হাইস্পীডে বলে দেওয়া বিজ্ঞাপনের শেষের কথাগুলো। এই খেলা নেশায় পরিণত হতে পারে। নিজের বুদ্ধি ও সংযম লাগিয়ে খেলবেন। ঠিক যেন সরকারী ফরমান। যে যার মত চুরি চামারী খুনোখুনি করো ঘুষ নাও, রেপ কর। একটু বিচারবুদ্ধি ও সংযম সংস্কার দিয়ে করো। তাহলেই হবে। 
দেবোত্তমের হাসি পায়। দুনিয়া এখন এরকম। একটা কম্পানির হয়ে দিনের বেলা কাজ। আবার তাদের কোড ব্যবহার করে সন্ধেবেলা মুনলাইটিং। করোনার সুফল। টাকা করতে জানলে যুদ্ধ মহামারী দু্ভিক্ষ এসব হচ্ছে আদর্শ সময়। ও আর কি করেছে, দেশের বস কয়েকজন ব্যবসায়ী তাদের এসেট দুবছরে দ্বিগুণ করেছে তার বেলা ? ওর একটা গাড়ীর ইচ্ছে ছিল অনেকদিন। ই ভি অটোম্যাটিক। বুক করেছে। ডেলিভারী একমাসের মধ্যে। আর নিউটাউনে একটা ফ্ল্যাট। আড়াইহাজার স্কোয়ার আড়াই কোটি। ইএম আই চালু হয়ে গেছে। যা রোজকার হচ্ছে দুটো কাজে, কমফরটেবল। 
-ক্রমশঃ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments