জ্বলদর্চি

সুপ্রাচীন শাস্ত্রচর্চার ধাম : খড়দহের ২৬ শিব মন্দির/প্রসূন কাঞ্জিলাল

সুপ্রাচীন শাস্ত্রচর্চার ধাম : খড়দহের ২৬ শিব মন্দির


প্রসূন কাঞ্জিলাল


খড়দা অথবা খড়দহ কলকাতার উপকণ্ঠে আরও একটি প্রাচীন জনপদ । মূলত শ্রীনিত্যানন্দের অনুসঙ্গ ধরেই এই এলাকাটি বৈষ্ণব আন্দোলনের একটি মূল কেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। শ্রীনিত্যানন্দ ইহলীলা সংবরণ করার পর তাঁর এক স্ত্রী জাহ্নবী দেবী ও পুত্র বীরভদ্রকে এই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায়। বীরভদ্রের উদ্যোগেই প্রতিষ্টিত হয় এখানকার বিখ্যাত শ্যামসুন্দর বিগ্রহ। সেই গল্প অন্য একদিন বলা যাবে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থা একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে এক শ্রেণীর মানুষ ব্রিটিশদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করে নবাবী আমলের জগৎশেঠ কিংবা উমিচাঁদের তুল্য ধন সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন। যারা কোম্পানি আমলে এজেন্ট হাউসগুলোর দেওয়ান ও মুৎসুদ্দী হতেন, পরবর্তীকালে তারাই নতুন নতুন ব্রিটিশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির এজেন্ট নিযুক্ত হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রইলেন। তাঁরা হয়ে উঠলেন এক একজন ধনী জমিদার।

ভুলুয়া (বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা এক সময় এ নামে পরিচিত ছিল) ও চট্টগ্রামের লবনের এজেন্ট হ্যারিস সাহেবের দেওয়ানী করে রামহরি বিশ্বাস প্রচুর উপার্জন করেন। দান বীর ও ধর্মীয় কাজে উৎসাহী হিসাবে নাম হয় তাঁর। খড়দার এই জায়গায় রামহরি বিশ্বাস প্রথমে ১২টি আটচালা শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮০৩ সালে রামহরি বিশ্বাস মারা যাওয়ার পর তাঁর দুই পুত্র প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস ও জগমোহন বিশ্বাস সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন এবং সেই সম্পদ আরও বাড়িয়ে তোলেন। সেই সময় কর্নওয়ালিসের দশশালা বন্দোবস্ত অনুযায়ী প্রয়াগ ও সন্নিহিত এলাকায় তীর্থযাত্রীদের তীর্থ কর দিতে হতো। জগমোহন বিশ্বাস এককালীন ২ লক্ষ টাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঘরে জমা দিয়ে সেই কর চিরদিনের মতো মুকুব করিয়ে দেন।

রামহরি বিশ্বাসের অপর পুত্র প্রাণকৃষ্ণ কোচবিহার ও সিলেটে দেওয়ানের কাজ করতেন । তাঁর আবার তন্ত্র চর্চার অভ্যাস ছিল। তিনি রামহরি বিশ্বাসের তৈরি দ্বাদশ শিবমন্দিরের পরে আরও ১৪টি আটচালার শিব মন্দির তৈরী করেন। সেই নিয়ে এই কমপ্লেক্সে মোট ২৬টি মন্দির স্থাপিত হয়। প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস একাধিক বই সংকলন করে বিনামূল্যে জনসাধারণের কাছে বিতরণ করেছিলেন, যা বাঙালির তন্ত্রচর্চার এক উজ্জ্বল পর্ব। এই বইগুলির মধ্যে আছে প্রাণতোষিণীতন্ত্র, বৈষ্ণবামৃত, বিষ্ণুকৌমুদী, শব্দকৌমুদী, ক্রিয়াম্বুধি প্রভৃতি।

শ্রীক্ষেত্র পুরীর মতো একটি ‘রত্নবেদী’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন প্রাণকৃষ্ণ। সেই জন্য তিনি আশি হাজার শালগ্রাম শিলা ও কুড়ি হাজার বাণলিঙ্গ সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু ১৮৩৫ তাঁর সালে অকাল প্রয়াণের পর সেই প্রক্রিয়া অসম্পূর্ন থেকে যায়।

প্রাণকৃষ্ণ সম্পর্কে আরও একটা খবর পাওয়া যায়। জগমোহনের মৃত্যুর পর প্রাণকৃষ্ণ তাঁর নাবালক পুত্রকে সম্পত্তির ভাগ দিতে অস্বীকার করেন এবং সেই বিবাদ সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। আদালতের বিচারে অবশ্য প্রানকৃষ্ণকে অর্ধেক সম্পত্তি তুলে দিতে হয় ভাইপোর হাতে।

যষ্টিমধু সাময়িকীর আষাঢ় ১৩৭৩ সংখ্যায় যতীন্দ্রমোহন দত্ত প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাসের ভাইপোর গল্প শুনিয়েছেন। নাম অম্বিকানন্দন বিশ্বাস। বড়মানুষির চূড়ান্ত করে সম্পত্তি সব উড়িয়ে দিয়ে আদালতে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করলেন ভদ্রলোক। এদিকে এক প্রতিবেশীর কাছে ৪০০০ টাকা দেনা ছিল, যা শোধ করেননি। পাছে তিনি আদালতে তাঁর দরখাস্তের বিরোধিতা করেন, সেই জন্য চার খিলি পান খাইয়ে বললেন – “আপনার দেনা শোধ হলো। আদালতে আর আপত্তি জানাবেন না। ”

প্রাণকৃষ্ণ কি এই ভাইপোকেই সম্পত্তির ভাগ দিতে চাননি ? সেই না চাওয়ার পেছনে কি তাঁর কোনো নিশ্চিত কারণ ছিল? শুধু প্রশ্নটাই আছে উত্তর নেই।

সহজিয়া বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিকল্প এক ধরণের সাধন মার্গ আছে, যা আখড়ার মোহান্ত – বাবাজীদের সাধন-করণ থেকে অনেকটাই আলাদা। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বলেন নিত্যানন্দ পুত্র বীরভদ্র তাঁদের আদি গুরু। তাহলে খড়দায় কি সেই বৌদ্ধ সহজিয়া তন্ত্র সাধনার এক প্রবহমান ধারা ছিল যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশিত হয়েছে? এই প্রশ্নটি আজও চর্চার বিষয়।

🍂

বহু বছরের পুরনো এই খড়দহ ২৬ শিব মন্দির । এই শিব মন্দির বাবুঘাট নামেও পরিচিত। এখানে অনেক দূর দূর থেকে প্রচুর মানুষ তর্পণের দিন  তর্পণ করতে আসেন এবং সুস্থ ভাবে গঙ্গায় নেমে স্নান করে তর্পণ করেন।কথিত আছে, নিত্যানন্দ প্রভু, নৌকায় এসে এখানে ঝুপড়িতে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং এই কাঠামোটি কুঞ্জাবতী নামে পরিচিত যা পর্যটকদের দ্বারা দেখা হয়।পাঁচটি গঙ্গার মুখোমুখি দুটি গ্রুপে সাজানো হয়েছে এবং বাকি ২১টি একটি আয়তক্ষেত্র হিসাবে সাজানো হয়েছে। সামনের কভারটিতে ইট মন্দিরগুলিতে স্টুকোর কাজ রয়েছে এবং কাট-ইটের পোড়ামাটির দুটি ছোটছোট ইট নির্মিত রয়েছে । টেরাকোটা সাজে সজ্জিত এই মন্দির যত্নের অভাবে এখন অনেকটা ভগ্নপ্রায়। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এর হেরিটেজ সাইট এর অন্তর্গত এই মন্দির।এই সকল মন্দিরগুলিই বাংলার মন্দির স্থাপত্যের আটচালা (আট ছাদের) শৈলীর। মন্দিরগুলি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে খড়দহের তৎকালীন জমিদার রামহরি বিশ্বাস এবং প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যখন আমরা শিব মন্দিরের কথা ভাবি, তখন প্রথম যে জিনিসটি আমাদের মনে আসে তা হল দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গম এবং বারোটি মন্দির ভারতের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গে এমন অনেক মন্দির রয়েছে যেখানে একই মন্দির চত্বরে বারোটি শিব মন্দির রয়েছে। কিন্তু এখানে খড়দাতে মন্দির সংখ্যায় বারোটি নয়, ছাব্বিশটি এবং তারা দুটি দলে বিভক্ত। গঙ্গার ঘাটের দিকে যেতেই একটি আলাদা ঘেরে বিশটি মন্দির দেখতে পাবেন এবং সেখানে প্রবেশের জন্য একটি গেট রয়েছে।
বাকি ছয়টি মন্দির যা ঘাটের ডানদিকে রয়েছে, একটি পৃথক বেষ্টনীতে স্থাপন করা হয়েছে এবং নদীর দিকে মুখ করা হয়েছে। এই ছয়টি মন্দির তুলনামূলক ভাবে ভাল রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। সিঁড়ির একটি ফ্লাইট আপনাকে মন্দিরগুলিতে নিয়ে যাবে।
গঙ্গামুখী প্রতিটি মন্দিরে একটি শিব লিঙ্গ রয়েছে যা সম্ভবত কোষ্ঠী পাথরের স্পর্শ পাথর দিয়ে তৈরি । সদর দরজায় ফুলের নকশার সাথে স্টুকোর কাজ রয়েছে এবং সেগুলি বড় কমপ্লেক্সের অন্যান্য মন্দিরেও দৃশ্যমান।মন্দিরগুলি ইটের তৈরি একটি উঁচু মঞ্চে রয়েছে এবং কিছু সংস্কার করা হয়েছে।
বড় কমপ্লেক্সের মন্দিরগুলি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে ছয়টি মন্দির বিপরীত দিকে (সংখ্যায় বারোটির মতো) এবং চারটি অন্য দিকে একে অপরের মুখোমুখি (পরিমাণ আটটি)। ফটকের দুই পাশে দুটি করে মন্দির রয়েছে।
যেসব মন্দিরের সংস্কার করা হয়েছে সেগুলো ভিন্ন রঙের। প্রাঙ্গণটি আয়তাকার। স্থানীয়রা আমাকে বলেছে যে বাংলা চৈত্র মাসে (এপ্রিলের মাঝামাঝি) নীল পূজার সময় ভক্তরা এই এলাকায় ভিড় করে এবং শিবের পূজা করে।

মন্দির কমপ্লেক্স পরিদর্শন করার জন্য, কেউ হয় ট্রেন বা বাসে যেতে পারেন।
 যদি বাস রুটে যাচ্ছেন, তাহলে শ্যামবাজার ৫-পয়েন্ট ক্রসিং থেকে ব্যারাকপুর যাওয়ার যে কোনও বাস নিন অথবা ট্রেনে করে খড়দহ স্টেশনে নামে,সেখান থেকে টোটো বা রিক্সা করে ২৬ শিব মন্দিরে যেতে পারেন। সময় লাগবে ১০ থেকে ১৫ মিনিট।   বি টি রোড ধরে আসলে যেখান থেকেই আসুন পিকে বিশ্বাস রোড বা খড়দহ থানা থেকে প্রবেশ করতে পারেন।

খড়দা থানার কাছে বাস স্টপে নামলেই দেখবেন আর্কেওলজিক্যাল সার্ভের বোর্ড। ২৬ শিব মন্দির। হেঁটে অথবা রিক্সা নিয়ে সহজেই পৌঁছে যেতে পারবেন। এই এলাকায় সম্ভবত একমাত্র সংরক্ষিত মনুমেন্ট; যদিও আমার কাছে শুধু খড়দা পৌরসভার মধ্যেই প্রায় কুড়িটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গার তালিকা আছে। আর্কেওলজিক্যাল সার্ভের সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করার যোগ্যতা নেই আমার। তবে একটা জিনিস বড় প্রয়োজন বলে মনে করি। এই ২৬ শিব মন্দিরের ইতিহাস কিন্তু কোনো ফলকেই লেখা নেই। থাকলে উৎসাহীরা জানতে পারতেন এই জায়গার সম্পর্কে ।


তথ্যসূত্র :---
১) জীবনীকোষ (ভারতীয় ঐতিহাসিক) --;পঞ্চম খণ্ড; শ্রীশশীভূষণ বিদ্যালঙ্কার সংকলিত!
২) সংবাদপত্রে সেকালের কথা দ্বিতীয় খণ্ড; শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়!
৩) আন্তর্জাল ও অন্যান্য।

Post a Comment

1 Comments