জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে অসাধারণে উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৩২

মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে অসাধারণে উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

গোড়ার কথা ― ১ :


'আমি একদিনও না দেখলাম তারে
বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথায় পড়শি বসত করে
             একঘর পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না দেখলাম তারে।'

―বলে গেছিলেন এক আধ্যাত্মিক বাউল কবি। আজ থেকে আনুমানিক প্রায় দেড়শ বছর আগে। তিনি সাধক লালন ফকির (১৭৭৪―১৮৯০)। গোঁড়া জাতি-ধর্ম-বর্ণ'র উর্ধ্বে মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং গভীর দার্শনিক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর বাংলাদেশে তখন বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। অথচ লেখাপড়া-না-জানা, স্কুলের গণ্ডি পার না-হওয়া এক বাউলের এ হেন সুগভীর দর্শন আপামর বাংলার মননকে অভূতপূর্ব নাড়া দিয়ে গেল। তিনি প্রদীপের শিখার তলায় যেটুকু অমানিশা ছেয়ে থাকে, তার নিচে ঢাকা-পড়ে-থাকা এক চিলতে আলো যেন। অবজ্ঞা আর অবহেলার পঙ্কিল সলিলে আজীবন নিমজ্জিত। অথচ নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস! সমকালীন সমাজে আজও তিনি বড্ড বেশি প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক তাঁর মনন, দর্শন আর চিন্তন প্রণালী। 

আসলে এ হেন গভীর দার্শনিক ভাবনা-চিন্তায় ব্যথিত লেখকের কোমল মন। বাড়ির নিকট যে আঁতুরঘর ― আরশিনগর, সেথায় যে-সকল অমূল্য রতন থাকে অনাদরে, অবহেলায়; সে-বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ আমরা। অথচ দূর আকাশের চাঁদ ধরতে গিয়েছি। আইনস্টাইন, নিউটন, স্টিফেন হকিং, আরও কত কী ভারী ভারী নাম! মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো দশা। বুঝতেও পারেনি, হিরে-মণি-মুক্তো খচিত খাঁটি সোনা আপন জন্মভূমিতে লালিত-পালিত। সে-সোনা অন্য কিছু নয়, বরং পরম প্রিয় পড়শি বৈজ্ঞানিক― যাঁদের জগৎজোড়া সুখ্যাতি আর আলমারি ভর্তি পুরস্কারের ডালি। রীতিমতো গর্ব করার মতো বৈজ্ঞানিক অন্বেষা ও এষণা। এবার তাই চাঁদ ধরা নয়, মরিচিকার পিছনে ছুটে বেড়ানো আর নয়; বাড়ির কাছে আরশিনগরে সত্যিকারের রক্ত মাংসের উজ্জ্বল নক্ষত্র যে ক'ঘর বৈজ্ঞানিক আমার পড়শি, তাঁদের অনুসন্ধানে পায়ের নিচে সরষে নড়ে উঠল। তাঁদের অনুপ্রেরণাময় উল্কা গতি আর উত্থানের রোমহর্ষক অথচ রূঢ় বাস্তব গল্প আকর্ষণ করল এক অমোঘ টানে। সে-গল্প শোনাব আজ। রওনা হই মেদিনীপুরে বিজ্ঞানের আরশিনগর― নারায়ণগড় ব্লকের ৪-নং কুনারপুর অঞ্চলের চকগনকা গ্রাম। সেখানে রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু'র মতো একঘর স্বনামধন্য পড়শি বসত করে যে। 

বর্তমান পৃথিবীর দুটি সবচেয়ে বড় সমস্যা― প্লাস্টিক দূষণ আর পানীয় জল সংকট। বড় সমস্যা বললে বোধহয় এড়িয়ে যাওয়া হয়, উপযুক্ত শব্দবন্ধ হওয়া উচিত―মারাত্মক সমস্যা। অন্তত আগামী প্রজন্মের নিকট। ধীরে ধীরে প্লাস্টিকের বিষ যেভাবে গ্রাম-শহর-নগর ভেদ করে বাড়ির অন্দরমহলে, মায় রান্নাঘরে জায়গা করে নিয়েছে; তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন পণ্ডিতকূল। তা, প্লাস্টিক থেকে তবে পরিত্রাণের উপায় কী? উত্তর কারও জানা নেই। নাহ, কেবল একজন বাদে। তিনি মেদিনীপুরের বৈজ্ঞানিক-গবেষক ড. নন্দগোপাল সাহু। তাঁর কাছে প্লাস্টিক আজ কোনও অজানা বস্তু নয়। কারণ, এ হেন প্লাস্টিক গলিয়ে ইতিমধ্যে তিনি 'গ্রাফিন' আর অপরিশোধিত তেল আবিষ্কার করে ফেলেছেন। যদিও তাঁর লক্ষ্য আপাতত পরিবেশের বর্জ্য― প্লাস্টিক থেকে সস্তায় অপরিশোধিত তেল তৈরি। গ্রাফিন আবিষ্কারের সৌজন্যে মিলেছে জাতীয় পুরস্কার। ২০১৮ সালে। অতি সম্প্রতি তাঁর মূল্যবান জহুরী নজর জীবনের এক অপরিহার্য অংশ― জলের উপর আপতিত। ভারত জুড়ে বিশুদ্ধ পানীয় জলের বড্ড আকাল। গ্রীষ্মে তা প্রকট হয়। সেজন্য তাঁর শ্যেন দৃষ্টি এবার পানীয় জল বিশুদ্ধীকরণের গবেষণায় মগ্ন। নিজের আবিষ্কৃত গ্রাফিন দিয়ে জল শুদ্ধিকরনের কাজে এখন সদা ব্যস্ত এই রসায়নবিদ।
      
এ হেন বৈজ্ঞানিক নন্দগোপাল বাবুর উত্থান আর পাঁচটা পল্লী-বালকের ন্যায়। ডাকাবুকো, মেধাবী অথচ চরম ফাঁকিবাজ। খুব সাধারণ তাঁর শৈশব। মাটির কাছাকাছি তাঁর কৈশোরের হাঁটাচলা। তাহলে কীভাবে সম্ভব হল প্রত্যন্ত গ্রামের সেই সাদামাটা ছেলে থেকে আজকের উচ্চতায় তাঁর এই উত্তরণ? শূন্য থেকে অসীমে উড্ডয়নের রোমহর্ষক বাস্তব গল্প? সেই অবিশ্বাস্য কাহিনী বেশ রোমাঞ্চকর। আবার রোমান্টিকও। তাঁর উত্থান গল্পের পরতে পরতে যেমন ছড়িয়ে আছে রসায়নের হিমালয়-উচ্চতাকে ছোঁয়ার হাতছানি, তেমনি সাধারণ স্টুডেন্ট থেকে ধাপে ধাপে অসাধারণত্বে পৌঁছনোর পশ্চাতে রয়েছে অমানুষিক পরিশ্রম আর কঠোর অধ্যবসায়।

(এক)
নারায়ণগড় ব্লকের ৪ নং কুনারপুর অঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত পল্লীগ্রাম চকগনকা। ধনী-গরিব মিলিয়ে নিত্যান্ত আটপৌরে এ গ্রামে সাকুল্যে পঁচিশ-তিরিশ ঘর অধিবাসীর বাস। ঘরে হয়তো অভাব আছে; কিন্তু পারস্পরিক হৃদ্যতার অভাব নেই, নেই মনের দৈন্যতা। সুখে দুঃখে, বিপদে আপদে, পুজো পার্বণে একসঙ্গে দিন কেটে যায় সাধাসিধে মানুষগুলোর। গ্রামের পূর্ব প্রান্তে আছে বেশ পুরোনো এক অশ্বত্থ বৃক্ষ। সে বৃক্ষের তলায় নাকি 'রাখাল-কানাই'-এর বাস। গাছের ডালে লাল সুঁতো বেঁধে অনেকে মানত করে। পূজো দেয়। পৌষ সংক্রান্তি তিথিতে এখানে জমাটি মেলার আসর বসে। এ হেন মেলাটি প্রায় দু'শ বছরের পুরাতন। মেলার সময় পুরো গ্রাম আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে। মেলায় কুইন্টাল কুইন্টাল গুড়বাতাসা হরিলুট করা হয়। প্রধান পুরোহিত 'রাখাল-কানাই'-এর চরণে বাতাসা নিবেদন করার পর মুঠো মুঠো বাতাসা পুন্যার্থীদের উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে দেন। মেলায় আগত নারী-পুরুষ ভক্তি ভরে কুড়িয়ে নেয় হরিলুটের বাতাসা। গুড়বাতাসা সংগ্রহে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গুড়বাতাসা-ধরা মুঠো মাথায়-কপালে ঠেকিয়ে প্রার্থনা করে অনাগত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। সুখ আর সমৃদ্ধির।
       
গ্রামের পশ্চিম পার্শ্বে সাহু পরিবারের বাস। দোতলা বিশাল মাটির বাড়ি। টঙে খড়ের ছাউনি দেওয়া। টঙের চারপাশে বারান্দায় থাক থাক টালির চাল, আলকাতরা মাখানো শুকনো বাঁশের তৈরি কড়ি-কাঠামোর উপর সজ্জিত। এই সাহু ফ্যামিলির শ্রীকুঞ্জবিহারী সাহু একজন নামকরা আয়ুর্বেদ চিকিৎসক। গ্রামজ গাছগাছালি, শেকড়বাকড়, জড়িবুটি সহকারে সর্দি-কাশি-ব্যাথা-বাত-জ্বরজাড়ি সারিয়ে তোলা তাঁর বাঁহাতের খেল। কুঞ্জ বাবু'র দুজন ছেলে। জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রী হরিপদ সাহু আর কনিষ্ঠ পুত্র শ্রী শ্যামাপদ সাহু। কনিষ্ঠ পুত্রের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভের সমসাময়িক সময়ে। কথিত আছে― সুযোগ্য পিতার উপযুক্ত পুত্র শ্রী শ্যামাপদ বাবুর উদ্যমে নতুন করে শুরু হয় উপরে বর্ণিত মেলাটি। মেলার জাঁকজমক পূর্বের চাইতে বাড়ে। সে অনেক কাল আগের কথা। মেলা শুরুর প্রকৃত তারিখ কী―আজও অজানা। তেমনি অজ্ঞাত মেলা স্থগিত হওয়ার কারণও। উদার প্রকৃতির মানুষ শ্রী শ্যামাপদ সাহু। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় বসেননি; পড়াশোনা যৎসামান্য, ক্লাস নাইন পর্যন্ত। সংসারের প্রয়োজনে আমিনি পেশা বেছে নিয়েছিলেন কম বয়সে। গ্রামে ঘরে পৈত্রিক সম্পত্তি বন্টন হোক, কি নতুন জায়গা কেনাবেচা অথবা সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা সংক্রান্ত বিবাদ― সবেতেই সুষ্ঠু মাপজোপের জন্য শ্যামাপদ বাবুর ডাক অবশ্যই পড়ত। মাপজোপের কাজে একটাই শর্ত ছিল খাদ্যরসিক শ্যামাপদ বাবুর। দেশী মুরগির পাতলা রঙঝোল চাই দুপুরের পাতে। তিনি ছিলেন প্রকৃত ভোজনরসিক। জম্পেশ করে প্রচুর মাংস খেতেন; সঙ্গে ভাজা মাছ আর ভাত। বয়সকালে বয়সের ভারে ন্যুব্জ তিনি। অথচ তাঁর নিস্তার নেই। জমি জায়গা জরিপের কাজে তিনি সকলের বিশ্বস্ত। চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়। তাঁকে ছাড়া কোনমতে সম্ভব নয় পরিমাপের কাজটি। সেজন্য বৃদ্ধ বয়সেও আমিনি-গিরি করতে হয়েছে তাঁকে।
 
তিনি ছিলেন পরোপকারী, সংষ্কৃতিবান আর বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। গ্রামের দিনমজুরদের বিপদে আপদে তাঁর কোমল হৃদয় বিগলিত হয়। সেজন্য অগ্রিম মজুরি দিয়ে সাহায্য করতে তাঁর হস্ত কম্পিত হয় না। এসব তাঁর কাছে জলভাত। চাষের সিজিন এলে বিনা পয়সায় গতর খেটে সে-পয়সা ওয়াশিল করে দেয় গরীবগুর্বো মানুষগুলো। তিনি ছিলেন একজন তুখোড় হা-ডু-ডু আর ফুটবল খেলোয়াড়। ফুটবলের গোলকিপার হিসাবে খুব নাম কুড়িয়েছিলেন যৌবনে। খেলোয়াড় হিসাবে বহু পুরস্কার পেয়েছেন জীবনে। হা-ডু-ডু খেলায় সোনার মেডেল পান। এ খেলার বিশেষত্ব হল― অন্যকে ছুঁয়ে দ্রুত ফিরে আসতে হবে নিজের জায়গায়। বিপক্ষ যেন ধরতে না পারে এমন বিদ্যুৎ গতিতে দৌড়তে হবে। এজন্য হা-ডু-ডু'তে মূলত রানার-এর ভূমিকা পালন করতেন তিনি। বাজপাখির মতো বিপক্ষকে খুব দ্রুত ছোঁ মেরে স্বস্থানে ফিরে আসতেন। পয়েন্ট বাড়ত দলের। হাততালির বন্যা বয়ে যেত। সাহু বংশের আর এক নামকরা সঙ্গী ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন জ্ঞাতিগত তুতোভাই শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাহু। শ্যামাপদ বাবু'র শখ ছিল ইন্দ্রজাল প্রদর্শনীর। বিভিন্ন জায়গায় ম্যাজিকের প্রদর্শনী হত। তাঁর ডাক পড়ত। তিনি যেতেন ম্যাজিক দেখাতে। দৃষ্টির সম্মুখ থেকে দৃশ্যমান বস্তু হামেশাই হাপিস করে দিতে পারতেন নিমেষে। বাড়ির ক্ষুদে অতিথিরা বেশ মজা পেত। হাততালি দিত। বাড়িতে একখান পাখি মারা বন্দুকও রয়েছে। ম্যাজিক দেখানোর কাজে এটি প্রায়শই ব্যবহৃত হত। মাঝে সাঝে সে-বন্দুক সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ছোটরা বেরিয়ে পড়ে পাখি মারতে― শামুকখোল, ডাহুক, বক।
      
পাশের সরিষা গ্রামে রয়েছে শ্রীশ্রী গোপীনাথজী ঠাকুরের মন্দির। সেখানে নিত্য যাতায়াত লেগেই থাকত তাঁর। যুক্ত হয়েছিলেন মন্দিরের সঙ্গে। তৈরি হয়েছিল মন্দির কমিটি। কমিটির কাজ ছিল শ্রীশ্রী গোপীনাথজী ঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচার। গ্রামে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে নামসংকীর্তণ সহযোগে ঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচার করত কমিটির লোকেরা। তিনি ছিলেন কমিটির সর্বাধিনায়ক। যেদিন যে-গ্রামে ঠাকুরের পদধূলি পড়ে, সেখানে ধূমধাম সহকারে বিরাট মহোৎসব হয়। এভাবে একসময় চারদিকে শ্রীশ্রী গোপীনাথজী ঠাকুরের বিরাট নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। কুনারপুর অঞ্চলে যে শারদীয়া দুর্গোৎসব প্রচলিত আছে, এক কালে তার সম্পাদক পদ অলংকৃত করেন তিনি। তাঁর আমলে খুব জাঁকজমক সমভিব্যাহারে বারোয়ারি শারদোৎসবটি সম্পন্ন হত। তাঁর-ই তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় দুর্গামন্দিরের দালান। উৎসবের ক'টা দিন অনুষ্ঠানের ঘনঘটা। অনুষ্ঠিত হত বিভিন্ন অপেরার যাত্রাপালা। সে-পালা দেখতে প্রচুর লোকের সমাগমে গমগম করত উৎসব প্রাঙ্গণ। দূর দূরান্ত থেকে পাড়ি জমাত যাত্রা-প্রিয় মানুষ। তিল ধারণের জায়গা থাকত না। এলাকার মানুষের ভালোবাসায় পঁচিশ বছরেরও বেশি সম্পাদক পদে আসীন ছিলেন তিনি। সত্তরের দশকের গোড়ায় যুক্ত হল রেশনের ডিলারশিপের ব্যবসা। ছোটবেলা থেকে অহর্নিশ শ্যামাপদ বাবুর মাথায় ঘুরঘুর করে বেড়ায় যাত্রাপালার নেশা। পরের দিকে এ নেশা সংসারে অশান্তি ডেকে আনে। স্ত্রী বিমলা দেবী কিছু বলতে গেলে হঠাৎ রেগে যেতেন। মুখের উপর তর্ক জুড়ে দিতেন। অবশ্য তাঁর রাগ বেশি ক্ষণ স্থায়ী হত না। ক্ষণিক পরে মেজাজ একেবারে ঠাণ্ডা; কমে যেত রাগ-অভিমান-মাথা গরম। 

সময়টা স্বাধীনতার পরের দশক। একান্নবর্তী সাহু পরিবার। খুড়তুতো জেঠতুতো শ্বশুর শাশুড়ি ননদ দেওর ভাসুর জা সব মিলিয়ে প্রায় জনা চল্লিশ―পঁয়তাল্লিশ ফ্যামিলি মেম্বার। সে যেন এক চাঁদের হাট। নিত্যদিন খুনসুটি, রাগ অভিমান লেগেই থাকে। প্রতিদিন দুবেলা বাড়িতে পিকনিক পিকনিক আমেজ। দুপুর-রাত্রে রোজ অন্তত দুবার লম্বা পাত পড়ে। ছেলে বুড়ো সকলে মাটিতে বসে লাঞ্চ-ডিনার সারে। এসময় সকলে একসঙ্গে জড়ো হয়। বেশ একটা খুশির আবহ। দোতলা মাটির বাড়িতে অনেক গুলো কামরা। বিশাল একখানা দালান। দালানে কচিকাঁচার নিত্য কলরবে মাটিতে স্বর্গ নেমে আসে। সেই মাটির ঘরে পুরো সাহু বংশের বাস। চকগনকা গ্রামের পশ্চিম পাশে। গোটা গ্রামে আর মাত্র কতিপয় পড়শি ঘর। 

সময়টা বিংশ শতাব্দীর মধ্য পাঁচের দশকের ঘটনা। পালকি চেপে বালিকা বধূ বাড়ি এল। গ্রামের মেঠোপথ ধরে। উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বণীর স্বরে। আর বড়দের আশীর্বাদ নিয়ে। নব বধূর বয়স সবে মাত্র তেরো বছর। দুধে আলতা গায়ের রঙ। দেবী প্রতিমার মতো মুখের গড়ন। বাড়ির ছোট ছেলে শ্যাম, ওরফে শ্যামাপদ সাহু। তার বয়েস অল্প, আঠারো কি উনিশ! কৈশোরের দশা পেরিয়ে সদ্য যৌবন উঁকি মারছে মনে। এমন সময় বিবাহ! পাশের সগুড়িয়া গ্রামে পাত্রীর বাড়ি। পাত্রী বিমলাদেবী খেলার পুতুল, রান্নার খেলনাপাতি ফেলে, বাল্যকাল-সখীকূল ছেড়ে তেরো বছর বয়সে চলে এলেন চকগনকা সাহু পরিবারে। পেছনে আত্মীয় পরিজনের অশ্রু মোচন, হাহুতাশ কানে ভেসে আসে। সেদিন তাঁর চোখের জলে ধুয়ে গেছল আল-ভাঙা সরু মেঠোপথ। অশ্বত্থ তলা। চকগনকায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ধবল বক, সাদা পেঁজামেঘ আর প্রিয় আগামী। অশ্রু শুকিয়ে যাবার আগে বড় পুকুরের পাড় ধরে অতীত পেছনে ফেলে পালকি এসে থামল সাহু বাড়িতে। উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করে নব বধূকে বাড়িতে তুললেন প্রিয় জেঠশাশুড়ি কুসুমবালা দেবী। কারণ নিজের শাশুড়ি নেই। খুব অল্প বয়সে বাবা-মা'কে হারিয়েছেন শ্যামাপদ বাবু।
       
এসে অব্দি বালিকা বধূর বেশ খাতির। অল্প দিনের ব্যবধানে সকলের প্রিয় পাত্রী বনে গেল সে। জেঠশাশুড়ি, খুড়শাশুড়ি সকলে খুব ভালোবাসে। আগলে আগলে রাখে নববধূকে। ঘরের অন্দরমহলে বেশ খুশি খুশি ভাব। ননদের সঙ্গে নিত্যদিন খুনসুটি। সারাদিন বাড়ির বড়দের টুকটাক ফাইফরমাস খাটা। দিব্বি দিন কাবার হয়ে যায় নববধূর। দিন কাবার হলে সন্ধ্যায় স্বামীর দেখা মেলে। উদার প্রকৃতির স্বামী শ্যামাপদ সাহু'র শখের অন্ত নেই। হাজারো শখ। তাঁর পড়াশোনার দৌড় খুব বেশি নয়। তবে জমি জায়গা জরিপে বেশ চৌকশ। একেবারে চোস্ত। মন দিয়ে কাজ করেন। নামজাদা আমিন। আমিনদার হিসাবে তাঁর বিশাল খাতির। এর সঙ্গে পরে যুক্ত হল রেশনের ডিলারশিপ। ষাটের দশকের শেষ লপ্তে। তুতোভাই শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাহু'র হারমোনিয়াম বাজিয়ে খালি গলায় গান গাওয়া বরাবরের অভ্যেস। হারমোনিয়ামের রিডে তাঁর আঙুলের ছোঁয়া পড়লে বাড়ির কচিকাঁচার দল গোল হয়ে বসে পড়ে তার চারপাশে।

সত্তরের দশকের শুরুর ঘটনা। ততদিনে অখণ্ড মাটির ঘরে অনেক ছোট ছোট চুলো জ্বলে। একান্নবর্তী সংসার আর নেই। প্রত্যেকের ছোট ছোট পৃথক সংসার। ততদিনে চকগনকায় বিমলা দেবীর পনেরোটা বসন্ত অতিক্রান্ত প্রায়। তখন তাঁর ভরা সংসার। ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছে বড় ছেলে অজিত। তারপর একে একে আটজন সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে― প্রতিমা, অসিত, অসীমা, সবিতা, অশোক, মিনু, ননীগোপাল আর নন্দগোপাল। ইতিমধ্যে একটি অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেছে। অনভিপ্রেত ঘটনা। ষষ্ঠ সন্তান অশোক হামাগুড়ি দিতে দিতে অকালে প্রয়াত হল, খুব ছোটবেলায়। সেসময় মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েন মা বিমলাদেবী। তাঁর চোখে গঙ্গা যমুনা বয় দিনরাত। অনেক কষ্টে কাটিয়ে ওঠেন সে পাথর-চাপা শোক-সন্তাপ। তারপর বাকি আট সন্তান নিয়ে বেশ সুখে শান্তিতে দিন কাটছে। খুশি পরিবার। সংসারে জমি জায়গার ভাগ বাটোয়ারা হয়েছে বটে। একান্নবর্তী সে-পরিবার আর একসঙ্গে নেই ঠিকই, কিন্তু এখনও খুড়তুতো শাশুড়ি-বৌমা, জায়ে-জায়ে অটুট হৃদয়ের টান, মনের মিল। ছোট ছোট টুকরোয় পরিনত হয়েছে দোতলা মাটির বাড়ি। পুরাতন বাড়ি ছেড়ে অনেক নতুন নতুন বাড়ি গজিয়ে উঠেছে। জ্ঞাতি, আত্মীয় পরিজন প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সংসার। সে-সকল ছোট ছোট ভিন্ন বাড়িগুলো মিলিয়ে এখন একটা পাড়া গজিয়ে উঠেছে চকগনকা গ্রামে― সাহু পাড়া।

(দুই)
আকাশে বাঁকা চাঁদ আর ছেঁড়া পেঁজা মেঘের লুকোচুরি খেলা জমে উঠেছে। রুপোলী জোছনালোকে ভিজে যাচ্ছে একটেরে খড়ের চালা, আমন ধানের ক্ষেত আর চরাচর‌। মৃদুমন্দ বাতাসে তরতর কাঁপছে বাঁশ পাতা। এ অঞ্চলে বাঁশ ঝোপের অভাব নেই। পঞ্চাশ-একশো হাত অন্তর অন্তর বাঁশের বন। বাঁশ এক সংঘবদ্ধ উদ্ভিদ। শয়ে শয়ে গাছ একসঙ্গে জন্মায়। অল্প জায়গার ভেতর ঠাসাঠাসি করে বেড়ে ওঠা যেন ওদের নিয়তি। সেজন্য ঝড়ে-জলে-প্লাবনে-দুর্যোগে সহজে ওদের টলানো যায় না, উচ্ছেদ করা যায় না। উচ্ছেদ করতে হলে সমূলে উৎপাটিত করতে হয় বংশ। অথচ সহজে নির্বাসনে যাওয়ার পাত্র নয় ওরা। যে-সব বাঁশ ঝোপের বাইরের দিকে পরিধি বরাবর থাকে, তাদের অধিকাংশের মেরুদন্ড আবার সোজা থাকে না। প্রায়শই সে-বাঁশের ডগাগুলো কোমর থেকে ঝুঁকে পড়ে পুকুরের জলে, মেঠো রাস্তার'পর, ঘরের টঙে। যেন অভিবাদন করছে―এমন ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান। বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ ফলে এ অঞ্চলে―তরল বাঁশ, ভেল্কি বাঁশ, কাঁটাবাঁশ, আরও কত কী নাম! আর আছে অর্জুন, দেশি আম, তেতুল, জামকুল, কঞ্জ্যা, বৈঁচি, কাঁটাকূল, কিসমিস, বাবলা প্রভৃতি গাছগাছালি। বাঁশের পাতার আড়ালে, অর্জুন গাছের ডালের ফাঁকে পুকুর ঘাটে মাঝে সাঝে আড়াল হচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদ। গাছের তলায়, পুকুর পাড়ে তখন চাপ চাপ অন্ধকার। গা ছমছম আলোক-আঁধারি পরিবেশ। দূরে-কাছে ভৌতিক ছায়ার মত নির্বাক বৃক্ষগুলো শিহরণের ঢেউ তুলছে। ভয় সিঞ্চন করে। জোছনালোকে এক ফসলি ধানের ক্ষেতে আধো আলো আর অসীম শূন্যতা। জুলাই-আগস্টে আমন ধানের চাষ বেশ ঘটা করে হয়। মাঠকে মাঠ সবুজের ছোঁয়া। সোনালি ফসল গৃহস্থের চোখে খুশির ঝলক বয়ে আনে। তবুও ফি-বছর অভাব অনটন লেগে থাকে। মহাজনের দেনা শোধ করতে করতে নিঃস্ব হয়ে যায় এক একটা ফ্যামিলি। যতক্ষণ মাঠের ফসল মাঠে বিরাজমান থাকে, সেটুকু দৃশ্য অবলোকন করেই চাষির মুখে হাসি, মনে বল। ফসল কাটা হয়ে গেলে খাঁ খাঁ করে মাঠখানি। চাষির ভেতরটাও ফাঁকা হয়ে যায়। তখন মাঠ জুড়ে শুধু ইঁদুর আর খ্যাঁকশেয়ালের রাজত্ব, অগভীর গর্ত। এর মাঝে আ-কাটা খড়ের নাড়াগুলি নির্বাক চেয়ে থাকে আকাশ পানে। ফুটিফাটা মাঠের দিকে চেয়ে থেকে হাহুতাশ করা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না দিন-আনি-দিন-খাই মানুষগুলোর।

এখন পুজোর পরে শীতের সূচনা। বাতাসে হিমের পরশ। সন্ধ্যার আকাশে খুশির দোলা। এসময় বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে যাত্রাপালার আসর বসে। নিত্য অভাব অনটনের সংসারে এক চিলতে আনন্দের বাতাস বয়ে আনে সে-যাত্রানুষ্ঠান। সরিষা-কুনারপুর তল্লাটে শ্যামাপদ সাহু'র যাত্রাপালার শখ কারও অজ্ঞাত নয়। এতদাঞ্চলে আর এক যাত্রা-পাগল মানুষ কুনারপুর গ্রামের শ্রী চিত্তরঞ্জন মাইতি। মূলত শ্যামাপদ বাবু'র প্রযোজনায় আত্মপ্রকাশ করে এক নূতন যাত্রাদল। নাম 'শ্যামসুন্দর অপেরা'। চিত্তবাবু যাত্রাদলের ম্যানেজার। ফি-বৎসর শীতের শুরুতে পালাগানের অগ্রিম আসে। যাত্রাদল নিয়ে দূর দূরান্তে রওনা হন ভাড়ার বাসে চেপে। বর্ধমান, আসাম, মেদিনীপুরের গ্রামগঞ্জ চষে বেড়ায় শ্যামসুন্দর অপেরা। শ্যামাপদ বাবু অপেরার মালিক। যাত্রার প্রোপাইটার। তিনি পালা'র বইমাস্টার (স্মারক)-ও। স্টেজের ডানদিকে কোনে, যে-জায়গাটায় মঞ্চে যাত্রার কুশীলব প্রবেশের জন্যে সিঁড়ি বাঁধা থাকে, তার পাশে নিচে পালার বই নিয়ে বসে থাকেন শ্যামাপদ বাবু। সেখানে বসেই বিভিন্ন ডায়লগ চাপা আওয়াজে আওড়াতে হয়। তা শুনে যাত্রার কুশীলবগণ আপন আপন পাঠ খালি গলায় সজোরে নিক্ষেপ করে; যাতে উপস্থিত সকল শ্রোতার কর্ণগোচর হয়। শ্যামাপদ বাবু'র বড়দা শ্রী হরিপদ সাহু আর তুতোভাই নগেন্দ্রনাথ যাত্রা পালা'র দুই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। পালায় রাজার পাঠ থাকলে চোখ কান বুজে ডাক পড়ত দেখতে সুন্দর হরিপদ বাবু'র। তাঁর মুখের গড়ন, চেহারা, হাঁটাচলা আর বর্ণ― সব-ই ছিল রাজারাজড়ার মত। সেজন্য সকলে তাঁকে 'রাজাবাবু' সম্বোধন করত। যাত্রায় অনেক পরে আগমন মাইক্রোফোন। রঙ-বেরঙের আলো। ডবল স্টেজ। আধুনিক সাইক্লোরামা পদ্ধতি।

তা, শ্যামাপদ বাবুর বাড়ির উঠোনের সম্মুখে, দক্ষিণ দিকে বেশ প্রসস্থ খোলা বাহির। পূর্ব-পশ্চিমে। বাহিরকে অনেকে 'খামার' বলে। সোনালি ফসল উঠলে এখানে ধান ঝাড়াই-বাছাই করা হয়। খামারের পাশ দিয়ে দুবার সমকোণে বাঁকানো মাটির রাস্তা গ্রামের অন্দরে ঢুকে গেছে। রাস্তার দক্ষিণে বড় একখানা পুকুর। তার জলে ঝিকমিক করছে চাঁদের আলো। পুকুর পাড়ে হরেক রকমের গাছ। বেশির ভাগই বাঁশের ঝোপ। হ্যাজাকের আলো জ্বলছে বাহির খামারে। পূর্ব দিক ঘেঁষে। মাটিতে চাটাই (শতরঞ্জি) পেতে ছোট মতন খোলামঞ্চ প্রস্তুত হয়েছে সেখানে। জনা পঁচিশ-তিরিশ আর্টিস্ট আর বাজনাদার বসে। নাটকের কুশীলব― সকলের বিনা মেকআপ। হারমোনিয়াম, তবলা, বাঁশি, ড্রাম, আরও অনেক বাদ্যযন্ত্র। আর গ্রামের কিছু উৎসাহী জনতা অধীর আগ্রহে বসে রয়েছে। তাদের রক্তে নেশায় রয়েছে যাত্রা, যাত্রার প্রতি অনমনীয় টান। তাদের পাশে রাখা নিজ নিজ কুপি, লম্ফের আলো। কেউ বা বিনা আলোকে অথবা অন্যের আলোকে যাত্রার রিহার্সাল দেখতে এসেছে।

আজ্ঞে হ্যাঁ, যাত্রার রিহার্সাল-এর আসর বসেছে সাহু বাড়িতে। সন্ধ্যায়। শ্যামাপদ বাবু প্রয়োজনে নির্দেশনাও করতেন। হাতে ধরে প্রতিটা সিন রিহার্সাল করে দেখিয়ে দিতেন। স্মারকের পাশাপাশি নায়ক নায়িকার দৃশ্যগুলো অভিনয় করে দেখিয়ে দেন অবলীলায়। সেজন্য প্রতিদিন সন্ধ্যায় আসর জমে ওঠে সাহু আলয়ে। মাঝে মধ্যে অবশ্য পাশের গ্রাম সরিষায় যাত্রার রিহার্সালের আসর পাতা হয়। যাত্রার বাজনা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে কাঁথামুড়ি দিয়ে জড়ো হয় গ্রাম্য শ্রোতৃবৃন্দ। রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত চলে ডায়লগ প্র্যাকটিস, গানের রেওয়াজ, অভিনয়। 

বিমলা দেবীর হয়েছে মহা জ্বালা! তাঁর ব্যস্ততার অন্ত নেই। রিহার্সাল দেখবার ফুরসৎ টুকু মেলে না। যাত্রার তিরিশ চল্লিশ জনের রান্নার সমূহ ভার তাঁর উপর ন্যস্ত। শ্যামাপদ বাবু কেবল বলেই খালাস। যত ঝামেলা পোহাতে হয় তাঁকে। মুখ বুজে সে-সব কিছু মেনে নিয়েছেন বিমলাদেবী। তাঁর কাছে দস্তুর মতো এটাই নিয়ম। রিহার্সালের ক'টা দিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাত্রাদলের সেবায় আত্মনিয়োগ করে বসেন তিনি। এ হেন শ্যামসুন্দর অপেরার ঝুলিতে বেশ কিছু হিট যাত্রাপালা। সুপারহিট হয়েছিল― 'সোনাই দিঘীর মেয়ে' আর 'এ পৃথিবী টাকার গোলাম' যাত্রাপালা দুটি। শেষের যাত্রাপালাটি একবার বাড়ির খামারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেবার তাড়াতাড়ি সব কাজ সেরে যাত্রানুষ্ঠানটি দেখেছিলেন বিমলাদেবী। ভালো লেগেছিল সে-পালা। স্বামীর সম্পর্কে গ্রাম্য সুধীজনের অকুণ্ঠ প্রশংসা আজও তাঁর কানে বাজে। গর্বে ভরে ওঠে বুক।

শ্যামাপদ বাবুর হাজারো শখ, নেশা। স্বাভাবিকভাবেই স্বামীর সেই স্বপ্ন পূরণের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক ব্যবসা আর তিনি, বিমলাদেবী। বিশেষত সাপ্তাহিক রেশন বন্টন ব্যবস্থা। তিনি বাইরে চলে গেলে অনিয়মিত হয়ে পড়ে রেশনের বাটোয়ারা। ঘরে পুরুষ মানুষ বলতে তিনি একাই। বড় ছেলে অজিত নিতান্তই বালক। কিশোর। ব্যবসাপাতির সে কী বোঝে? শুধু মাঝে সাঝে বাবার সঙ্গে বসেছে রেশনের কেরোসিন, চিনি বিলি করতে। অভিজ্ঞতা বলতে সেটুকুই। এভাবে বাড়ির কাজে হাত লাগাতে গিয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়ে তার পড়াশুনা। অচিরে স্কুলের পাঠ অকালে বন্ধ হয়ে যায় বড় ছেলে অজিত-এর। পিতার অবর্তমানে রেশনের বন্টনে হাত পাকায় সে। অল্প বয়সে ডিলারশিপ ব্যবসার হালহকিকত তার করায়ত্ত হয়।

 (তিন)
অগ্নিগর্ভ সত্তর। বিদ্রোহী সত্তর। বিপ্লবের আগুনে দগ্ধ সত্তর। উত্তাল। উদভ্রান্ত। দিশেহারা সত্তর। সত্তরের দশকের একেবারে প্রথম ভাগ। সংগ্রামের আগুন জ্বলে উঠে ছড়িয়ে পড়ল সারা বাংলায়। বাতাসে বারুদের সৌরভ। আকাশে ঘন ঘন ফাইটার প্লেনের ওঠানামা। হৃদয়ে অবিশ্বাসের চোরা স্রোত। সমাজে সন্দেহের বাতানল। সমাজে পট পরিবর্তনের সে এক মহার্ঘ্য সময়। জোতদার, জমিনদার, মহাজনের বিরুদ্ধে বাংলার আকাশ গর্জে উঠছে ক্ষোভে। মালিকের চোখে চোখ রেখে রাগে প্রতিবাদে আজন্ম সঞ্চিত ক্রোধানল উগরে দিচ্ছে শোষিত শ্রমিক সম্প্রদায়। মোড়ে মোড়ে হঠাৎ গজিয়ে উঠছে শ্রমিক ইউনিয়ন, ক্লাব আর মজদুর সংগঠন। মান্ধাতার আমলের রীতি নীতির পরিবর্তন চাই। চাই সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা। লেলিন, মার্ক্সবাদ, মাও সে তুঙ তখন সকলের মুখে মুখে ঘুরছে। পুলিশ আসুক, চৌকিদার আসুক, নেতা-মন্ত্রী যে-ই আসুক না কেন; নো-পরোয়া! কোনও তোয়াক্কা নেই ওদের। এদের এই শ্রেণী সংগ্রামে যুক্ত হয়েছে কিছু শিক্ষিত যুব সমাজ। তাদের চোখে একরাশ স্বপ্ন। সমাজ সংসারে আমূল পরিবর্তনের নেশা। সমতার কথা শোনায় তারা। ধনী দরিদ্র ভেদাভেদ মুছে ফেলে ঐক্যের বাণী শোনায় কলেজ ইউনিভার্সিটি পড়া শত শত ছেলে ছোকরার দল। তারা সব ঝাঁকে ঝাঁকে নাম লেখাচ্ছে সংগঠনে। নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিপ্লবের দলে। নাম পরিবর্তন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শানাচ্ছে গ্রামেগঞ্জে। ধরা পড়লে জেলহাজত বাস, অকথ্য অত্যাচারেও ওদের টনক নড়েনি।

আসলে শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে যে-আগুন একদিন নকশালবাড়ির চৌহদ্দির ভেতরে দগদগ করে জ্বলছিল, তা নিমেষে ছড়িয়ে পড়ল আকাশে, বাতাসে, সারা বাংলায়। বাংলার আকাশে সে এক কালো দিন। অনিরাময় ক্ষত। দূরারোগ্য ক্যানসার যেমন শরীর অভ্যন্তরে আস্তে আস্তে ছড়ায় তার শাখা প্রশাখা, তৎকালীন সামাজিক বিষ গ্রাস করেছিল সেই সমগ্র মেকি সমাজ ব্যবস্থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পূর্ব বঙ্গের অনমনীয় স্বাধীনতার লড়াই। আকাশে তখন ঘন ঘন বিমানের ওঠানামার শব্দ শোনা যায়। আপদকালীন সাইরেন বেজে ওঠে। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।

দু-তিন সাল পরের ঘটনা। বিদ্রোহের করাল আগুন কিছু স্তিমিত। এতদিন যারা শ্রেণি সংগ্রামের লড়াই লড়ছিল, মোহভঙ্গ হয়েছে তাদের। অলীক মরিচিকার পেছনে ছুটে ছুটে ক্লান্ত তারা। নাহ! সোনার হরিণ ডিম পাড়েনি; কখনও ডিম পাড়ে না। এই আপ্তবাক্য হৃদয়ঙ্গম হতে দলে দলে ভগ্ন হৃদয়ে তারা সকলে ঘরে ফিরে এল অথবা নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, কোনও খোঁজ খবর নেই। কেউ তাদের খোঁজ করে না, খোঁজ রাখে না। ওপারে বাংলাদেশে সার্থক হল বিপ্লবের লড়াই। স্বাধীন রাষ্ট্রের তকমা পেল বাংলাদেশ। আস্তে আস্তে বিপ্লবের আগুন গেল নিভে; শান্ত হল পরিবেশ। আপাত ঠাণ্ডা হল মানুষের ভেতরকার আগুন। অনেক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস অপূর্ণ রয়ে গেল। বর্ষাস্নাত বৃষ্টিধারার পরে আলোকোজ্জ্বল সোনালি বিকেলের মত হাঁটি হাঁটি পা পা করে শুভ সময় হাজির হল; এল ১৯৭৩ সালের শরৎ। বাতাসে তখন আগমনি সুর। খাল বিল মাঠ ঘাট সর্বত্র কেবল সাদা কাশফুল। আকাশপানে সাদা ছেঁড়া পেঁজা মেঘের ভেলায় ভেসে চলেছে অপু আর দুর্গা, তেপান্তরের মাঠে। সেই যেথায় পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর একসঙ্গে খেলা করে। রেললাইনের ধারে কাশের বনে উড়ে বেড়ায় রঙিন প্রজাপতি। চৌধুরীদের আমের বনে নামে বৃষ্টির ফোঁটা, মুষলধারে। বৃষ্টির জলে ভিজতে কচিকাঁচার আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকে না!
    
ঢাকের বাদ্যি বাজে, চড়াম চড়াম। গতকাল ছিল অসুরনাশিনীমা দেবীদূর্গার বোধন। আজ মহাসপ্তমী। আজ ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসের তিন তারিখ। মহাসপ্তমীর পূজার তালে তালে ঢাকের কাঠির বোল আছড়ে পড়ে চকগনকা সাহু পরিবারে। ওদিকে ঢাকের চড়াম-চড়াম আওয়াজ আর এদিকে গর্ভধারিণী মায়ের আকুল চিৎকার, গর্ভ-যন্ত্রণা। নবজাতকের প্রথম কান্না। তিনে মিলে মিশে একাকার। এ এক অদ্ভূত সমাপতন। রাজযোটক মিল। এমন শুভ ক্ষণে শ্রী শ্যামাপদ সাহু'র পত্নী বিমলাদেবী'র নবম গর্ভে জন্ম নিয়েছিল এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান। নন্দগোপাল। দেবীপক্ষে নন্দগোপাল এল বিমলাদেবীর কোল আলো করে। তাঁর শুভ জন্মক্ষণেই রচিত হয়েছিল উজ্জ্বল তারা হয়ে প্রস্ফুটনের ঘোর যুদ্ধফল। রসায়নে ভবিষ্যতের তারা সে। অসুরদলনী মা দেবীদুর্গার কৃপায় মাতৃ জঠর থেকে যেন আবির্ভাব ঘটল তাঁর। মোটামুটি ফর্সা গায়ের রঙ। ছটপটে। নবজাতকের কান্নার সুরে যারপরনাই খুশির আভা খেলে গেল রত্নগর্ভা মাতা বিমলাদেবীর চোখে মুখে। উৎসব মুখর বাড়িতে আনন্দের হিল্লোল। খুশির জোয়ার। পূজোর আনন্দ এবার তাই দ্বিগুণা। (চলবে)

তথ্যঋণ :
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের রত্নগর্ভা মাতা বিমলাদেবী
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের জ্ঞাতিখুড়ো শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের মেজদা শিক্ষক শ্রীঅসিত কুমার সাহু
পরম শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক-গবেষক ড. নন্দগোপাল সাহু, কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি, নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments