মূল মন্দিরের বিশালাকায় বোঞ্জ বুদ্ধমূর্তি
উদয়ের পথে
একবিংশতি পর্ব
মলয় সরকার
আসলে, জাপানের এই মেইজি যুগ বলতে বোঝায় ১৮৬৮ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত, যখন জাপানে নতুন যুগের হাওয়ার ঢেউ আসে। পাশ্চাত্য ঢঙ্গে আধুনিকতার আমদানী হয় এই সময়।Keio যুগের সামন্ততান্ত্রিক মধ্যযুগীয় জমিদার তন্ত্র বা সামুরাইপ্রথা থেকে সম্রাট মেইজি দেশকে এক নতুন যুগের হাওয়ায় আনতে চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময় দেশে এক রেনেশাঁসের হাওয়া লাগে সব কিছুতেই। জাপানের পুরানো যুগের প্রথা থেকে বেরিয়ে দেশকে নতুনের পথে এগিয়ে যেতে তা অনেকখানিই সাহায্য করেছিল। ফলে আজকে যা হয়েছে, তার অনেক খানির বীজ রোপন হয়েছিল সেদিনই।
এগোলাম তোদাইজির মন্দিরের দিকে।এই তোদাইজির মন্দিরে এসে দেখি এখানেও সেই সব হরিণেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে ইচ্ছেমত। আশেপাশে যে সমস্ত দোকানগুলো রয়েছে, পর্যটকদের জন্য, সেখানেও অবাধ যাতায়াত এই হরিণদের।
এখানে এসে একটা সমস্যা হল। জাপানীতে সব লেখা। কোথাও ইংরাজীতে কোন লেখা নেই । ফলে কোনদিকে গেলে ঠিক মন্দিরে পৌঁছাব বুঝতে পারছি না। ফলে ভুল পথে অনেকখানি চলে গেছি। এদিকে গুগলও উল্টোপাল্টা দেখাচ্ছে। দু একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। তারা বুঝতে না পেরে উত্তর দিতে পারল না।
এক ভদ্রমহিলা যাচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম।তিনি বুঝতে না পেরে চলে গেলেন। হঠাৎ দেখি, উনি ফিরে আসছেন। আমাদের অবস্থা সঙ্কট বুঝে, বা নিজেই হয়ত কিছু আন্দাজে বুঝেছেন আমাদের জিজ্ঞাস্য। এসে আমাদের দেখিয়ে দিলেন যে সঠিক কোন দিকে গেলে আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাব। আমরা তখন অকূলে কূল পেলাম।এখানে মানুষের পরোপকারী প্রবৃত্তি আমাকে মুগ্ধ করেছে।
তোদাইজীর মূল মন্দির
সবাই যেন সাহায্য করার জন্য আগ বাড়িয়েই রয়েছে।তখন কি মনে হয়, আমি স্বদেশে না বিদেশে?
যাক এগিয়ে দেখি অনেকে টিকিট কাটছে লাইনে দাঁড়িয়ে। আমরাও দাঁড়ালাম। এখানে সমস্ত মন্দিরেই টিকিটের ব্যবস্থা, সেটা আগেই বলেছি, সেগুলো কিন্তু খুব সস্তা এমন ভাবার কোন কারণ নেই।চীনেও দেখেছি একই ব্যবস্থা।আমি বুঝতে পারিনা। যেখানে মানুষ একটু দেবতার কাছে গিয়ে আত্নসমর্পণ করবে কি আত্মশুদ্ধি করবে, সেখানেও এই আর্থিক ব্যাপারটা থাকা উচিত কি না। পরমার্থিকের সাথে আর্থিকের যোগাযোগ থাকা কি খুবই জরুরী? জানি না।
যাই হোক, ঢুকলাম, বিশাল এক কাঠের দরজা দিয়ে। সে তো মন্দিরের দরজা নয় যেন কেল্লায় ঢুকছি, এমনি তার বিশালতা ও ব্যবস্থা।তার নাম Nandaimon Gate।তার দুপাশে দুটি ভীষণ দর্শন মূর্তি রয়েছে। তারা সম্ভবতঃ কোনও দেবতা।তার পরেও বেশ খানিকটা যেতে হয় ।তবেই আসল মন্দিরের কাছে পৌঁছানো যাবে।
এই মন্দিরটি একটি বৌদ্ধমন্দির, যা ৭৫২ খ্রীঃ তে তৈরী হয়েছিল এবং জাপানের সমস্ত বৌদ্ধমন্দিরের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে এটির অবস্থান ছিল।তখন নারা ছিল জাপানের রাজধানী।এক সময়ে এই মন্দির সরকারী কাজেও হস্তক্ষেপ করত, এতই ছিল এর ক্ষমতা।পরে সেই ক্ষমতাকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে জাপানের রাজধানী নারা থেকে সরিয়ে কিয়োটোতে নিয়ে যাওয়া হয়।
নারার মৃগদাবে কন্যা ও হরিণ শিশু
এখানে প্রধান মন্দিরের সামনে অনেক চওড়া বাঁধানো , অনেক বড় রাস্তা রয়েছে, যেটি অতিক্রম করে তবে মন্দিরে যাওয়া যাবে।রাস্তার দুপাশে রয়েছে বিশাল ঘাসের লন । কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই হলটিই ছিল সারা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বড় কাঠের হল। এর ভিতরে যে বুদ্ধ মূর্তি আছে বা গ্রেট বুদ্ধ, তা এক কথায় বিশাল।তাঁর নাম এখানে Daibutsu। মূর্তিটির উচ্চতা ১৫ মিটার।আর হলটির নাম Daibutsuden, যেটি ৪৫ মি উচ্চতার।
আমরা তো হল ঘরে ঢুকে স্তম্ভিত। এই মূর্তিটি তাওয়াং এর মূর্তির (৮.৫ মি প্রায়) প্রায় দ্বিগুণ।যাঁরা তাওয়াং গিয়েছেন ও সেই বুদ্ধ মূর্তি দেখেছেন, তাঁরা এর সম্যক ধারণা করতে পারবেন।মন্দিরে ঢোকার আগে সিঁড়িতে ওঠার মুখেই রয়েছে , জাপানে যেমন সব মন্দিরেরই থাকে , তেমন বিশাল এক বাতিদান।
ভিতরে দুই বোধিসত্বের মাঝে রয়েছে বুদ্ধ মূর্তি। এই মূর্তিটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্রোঞ্জ বুদ্ধমূর্তি।
আর প্রচুর সুন্দর সুন্দর সত্যি ফুল আর আসল গাছে সাজানো মন্দিরের ভিতরে বেশ কয়েকটি ছোট বুদ্ধমূর্তিও আছে। এ ছাড়া বেশ কিছু অন্য মূর্তিও আছে।
এছাড়া রয়েছে মন্দির চত্বরের মধ্যে, হলের বাইরে একটি মিউজিয়াম, যাত্র নাম Todaiji museum, এখানে নানা বিক্রয় যোগ্য আর্টের কাজ রয়েছে। এটি ২০১১ সালে শুরু হয়।আরও রয়েছে কতকগুলি হল, যাদের নাম Nigatsudo Hall,Hokkedo Hall,Kaidando Hall,Shosoin Storehouse ইত্যাদি, যেগুলো নানা কাজে ব্যবহার করা হয়।
একটি বিশেষ কথা ,পরবর্তীকালে জানা যায়, বিজ্ঞানীরা এক্সরে ব্যবহার করে দেখেছেন, ‘গ্রেট বুদ্ধ’এর হাঁটুর ভিতরে রয়েছে একটি মানুষের দাঁত, মুক্তা, আয়না, ছোরা ও নানা মণিমাণিক্য। অনেকে বিশ্বাস করেন এগুলি সম্রাট শোমুর , যিনি এটি তৈরী করিয়েছিলেন।
তবে এই তোদাইজির মন্দিরের বিশালত্ব মানুষকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে ভাবতে সাহায্য করবেই।এই মন্দিরও ধ্বংস করা হয় ১১৮০-৮৫ সালের জেনপেই গৃহযুদ্ধে।এটি প্রথম নির্মিত হয় ৭৪৫ -৭৫২ সালে সম্রাট (Shomu) শোমুর হাতে।যিনি গোটা দেশে বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম বলে মেনে নেন। এই মূর্তির যখন চক্ষুদান পর্ব হয়, তখন এক বিশাল ব্যাপার হয় । দশ হাজার সন্যাসী ও চার হাজার নর্তকীর উপস্থিতিতে, ভারতীয় সন্যাসী বোধিসেনা এটির চক্ষুদান করেন।
অর্থাৎ ভারত সেই প্রাচীন যুগ থেকেই জাপানের সাথে সাংস্কৃতিক ব্যাপারে যুক্ত অথচ আমরা তার খবরই রাখি না।
প্রায় ৫০০ টন ওজনের এই ব্রোঞ্জের মূর্তির উচ্চতা ১৪.৯৮ মি।
এই তোদাইজির মন্দিরে বহু সিনেমা, মিউজিক ইত্যাদির স্যুটিং হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল (১৯৯৪) The Great Music Experience এখানে অনুষ্ঠিত হয়।
🍂
আরও পড়ুন 👇
আমরা প্রায় দিনের শেষ পর্যন্ত এখানে ছিলাম। আসলে চলে আসতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু দিন শেষ হয়ে এল, মন্দিরের সময়ও শেষ।আমাদের বেরোতেই হত।
বেরোতে হল অন্য এক দরজা দিয়ে। আজ সারাদিনে যা প্রাপ্তি হল তার পরিমাণ বড় কম নয়। এই সঞ্চয় করে এগিয়ে চললাম হোটেলের পথে নারা স্টেশনে।এখানে এসে একটি হোটেলে খাওয়া হল Taco Yaki ।
কিয়োটো স্টেশনে পৌঁছে, আমরা ভাবলাম, খেয়েই বাড়ি যাই। গেলাম গুগলের হাত ধরে খুঁজে একটি দোকানে। খাওয়া হল Seafood Okonomiyaki, Shrimp Yakisoba, Grilled edamame with charred butter and Soy sauce,
এখানে একটি ঘটনা ঘটল, যেটিই একমাত্র খারাপ অথচ ভাল ঘটনা এই জাপান যাত্রায়।এখানে এরা বসায় এক অদ্ভুত ভাবে, যেটি জাপানের ট্র্যাডিশনাল খেতে বসার নিয়ম। এই নিয়ম হল, খাবার টেবিল অপেক্ষাকৃত অনেক নীচু। খেতে হয় পা মুড়ে মাটিতে বসে।যদিও এখানে আমাদের পুরো সেইভাবে হয় নি, আমাদের একইভাবে বসতে হল তবে একটু উঁচুতে একটি বেদির উপর।জুতো নীচে খুলে রাখতে হল।
নারার বিচরণরত হরিণের দল
ভাবলাম, কোন দেশ কি পুরো স্বর্গ হতে পারে! দোষগুণ সব দেশের মানুষেরই আছে। কোথাও কম, কোথাও বেশি। তবে শাস্ত্রে বা সাহিত্যে সব জায়গায় তো গুণ ধরার কথাই বলা আছে, দোষ না ধরে।” তবে যদি দয়া কর, ভুল দোষ গুণ ধর–” কিংবা “প্রভু জী মেরে অবগুণ চিত না ধর “।কিংবা শ্রী পরমহংস দেবের কথাতেও আছে, গোলমালের গোলটি ছেড়ে মালটি নেবে। কাজেই আমরা সেই মালের সন্ধানেই ফিরি।
সঙ্গে থাকুন আর কিছুদিন। অনেক তো পথ হল চলা, হলও অনেক দেখা। তবু পথেরও যেমন শেষ নেই, দেখার বা জানারও শেষ নেই–। আমি নিরুদ্দেশের পথিক। তাই পথ চলি আর সঙ্গে নিতে চাই , অন্ততঃ পথিক-মনস্ক বন্ধুদের। উপভোগ করতে করতে চলি পথের বৈচিত্র্য–
ক্রমশঃ–
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments