জ্বলদর্চি

মহাভারতের স্বল্পখ্যাত কিছু চরিত্র/দ্বিতীয় পর্ব/ প্রসূন কাঞ্জিলাল

মহাভারতের স্বল্পখ্যাত কিছু চরিত্র
দ্বিতীয় পর্ব 
প্রসূন কাঞ্জিলাল

ইরাবন 

আরাবন অথবা ইরাবন। ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের পুত্র ছিলেন রূপান্তরকামী আরাবন। অর্জুন এবং নাগকন্যা উলুপির সন্তান ছিলেন তিনি। বাবার মতোই তিনি ছিলেন শস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। পাণ্ডবদের হয় কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে যোগ দেন আরাবন।

মহাভারতের ৯-এর শতকের তামিল অনুবাদে পাওয়া যায় কালাপ্পালি নামে এক প্রথার উল্লেখ। এই প্রথা অনুসারে যুদ্ধে যদি কোনও বীরপুরুষ দেবী কালীর সামনে নিজেকে বলি দেন, তো যুদ্ধে সেই পক্ষের জয় অবশ্যম্ভাবী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয় সুনিশ্চিত করতে নিজেকে উত্‍সর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন আরাবন। রূপান্তরকামী আরাবন শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে ৩টি বর লাভ করেন। একটি হল যুদ্ধে বীরের মৃত্যু বরণ করা, দ্বিতীয়টি হল ১৮ দিনের যুদ্ধ পুরোটা দেখার সৌভাগ্য লাভ করা এবং তৃতীয়টি হল মৃত্যুর পর তাঁকে যেন দাহ করা হয়।
আসলে সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী অবিবাহিতদের মৃত্যুর পর দাহ না করে কবর দেওয়া হত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় পর্যন্ত আরাবন ছিলেন অবিবাহিত। যুদ্ধে তিনি নিজেকে দেবী কালীর কাছে উত্‍সর্গ করবেন, এটা জানার পর কোনও নারী তাঁকে বিয়ে করতে চাইছিলেন না। তাই শ্রীকৃষ্ণ নারী শরীর ধারণ করে মোহিনী নাম নিয়ে আরাবনকে বিয়ে করেন এবং মৃত্যুর আগে তাঁরা এক রাত একসঙ্গে কাটান। আরাবনের মৃত্যুর পর নারীরূপী শ্রীকৃষ্ণ বৈধব্য বেশ ধারণ করে শোক পালন করেন। পরের দিন তিনি আবার নিজের আসল চেহারায় ফিরে আসেন।

তামিলনাড়ুতে আরাবন ও মোহিনীর পুজো হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যতদিন চলেছিল, সেই ১৮ দিন ধরে চলে উত্‍সব। তামিস মাস সিট্টিরাই-তে এই উত্‍সব হয়। স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী, রূপান্তরকামীরা এই উত্‍সবের মধ্যে দিয়ে আরাবনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং আরাবনের উত্‍সর্গের পরে রূপন্তরকামীরা বৈধব্যবেশ ধারণ করে শোক পালন করেন।

🍂

  গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ

 বারণাবত নগরে জতুগৃহ দাহ পর্বের পরে, রক্ষা পেয়ে পঞ্চপাণ্ডবরা গঙ্গা নদীর তীরে এসে পৌঁছান  ও সোজা দক্ষিণ দিকে চলতে লাগলেন।শুরু হোলো তাদের অঞ্জাতবাস।এই অঞ্জাতবাসের  কালে হিড়িম্ব বধ,  ভীমের হিড়িম্বাকে বিবাহ, বকরাক্ষস বধ ইত্যাদির পর তারা এক চারণ ব্রাম্ভণের কাছ থেকে শুনলেন পাঞ্চালরাজ ধ্রুপদ এর পুত্রার্থে যজ্ঞ ও সেই যজ্ঞাগ্নি খেকে যাঞ্জসেন ( ধৃষ্টদ্যুম্ন ) ও যাঞ্জসেনীর ( দ্রৌপদী ) আবির্ভাব বৃত্তান্ত । তখন মাতৃ আজ্ঞায় তারা পাঞ্চাল দেশের দিকে রওনা হলেন। এই পথে এক রাতে তাদের সাথে দেখা হয় গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণের যাঁর অপর নাম ছিল চিত্ররথ। সোমাশ্রয়ণ তীর্থে গঙ্গাতীরে অঙ্গারপর্ণ যখন তাঁর ভার্যা কুম্ভীনসী ও অন্যান্য স্ত্রীদের নিয়ে জলক্রীড়া করতে এসেছিলেন, তখন পাণ্ডবদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। পাণ্ডবরা বারণাবতে জতুগৃহদাহের পর নানান জায়গা ঘুরে তখন পাঞ্চাল দেশের দিকে যাচ্ছিলেন। অঙ্গারপর্ণ পাণ্ডবদের স্থানত্যাগ করতে বললে, অর্জুন সন্মত হন না। তখন অর্জুনের সঙ্গে অঙ্গারপর্ণের যুদ্ধ হয়। অর্জুন দ্রোণ প্রদত্ত এক আগ্নেয় অস্ত্র নিক্ষেপ করতে অঙ্গারপর্ণের রথ দগ্ধ হয় এবং অঙ্গারপর্ণ হতচেতন হয়ে পড়ে যান। পরাজিত অঙ্গারপর্ণ পরে চেতনা ফিরে পেয়ে অর্জুনকে তাঁর চাক্ষুষী বিদ্যা (ত্রিলোকের যা কিছু এই বিদ্যাবলে দেখতে পাওয়া যায়) দান করেন। অঙ্গারপর্ণের পরামর্শে পাণ্ডবরা দেবল ঋষির কনিষ্ঠ ভ্রাতা ধৌম্যকে কুল-পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত করেন।


  ঋষি অণীমাণ্ডব্য 

জনৈক মৌন ঋষি। এঁর প্রকৃত নাম ছিল মাণ্ডব্য। একদিন ইনি তাঁর আশ্রমের প্রবেশদ্বারের কাছে যোগাভ্যাসে মগ্ন ছিলেন। এমন সময় একদল চোর চুরি করে নগরপালের তাড়া খেয়ে এই আশ্রমে প্রবেশ করে এবং আশ্রমের এক কোণে লুকিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর নগরপাল ওই চোরগুলিকে খুঁজতে খুঁজতে আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। নগরপাল মুনিকে চোরদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে, এই ঋষি মৌন-যোগাভ্যাসে থাকার জন্য কোন উত্তর করলেন না। বেগতিক দেখে চোরেরা চুরিকৃত মালামাল রেখেই পালিয়ে যায়। নগরপাল মুনির কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে, আশ্রম তল্লাসী করে চুরিকৃত দ্রব্যাদি পায়। ফলে নগরপাল চোরদের আশ্রয়দাতা হিসাবে, বিচারের জন্য মুনিকে রাজদরবারে নিয়ে আসে। রাজা বিচার করে এই মুনির শূলদণ্ডের আদেশ দেন।

    যথাসময়ে এই আদেশ কার্যকর করার জন্য এঁকে শূলে চড়ানো হয়। কিন্তু শূলে দীর্ঘকাল কাটানোর পরও, তাঁর মৃত্যু না হলে− রাজা এসে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাঁকে মুক্তি দেন। কিন্তু তাঁকে শূল থেকে নামানোর চেষ্টা করা সময় দেখা গেল যে, শূল থেকে ইনি বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন না। ফলে শূলের ( শূল এর আরেক অর্থ -- অণী ) বাইরের অংশটুকু কেটে বাদ দেওয়া হয়। এই ভাবে শূলবিদ্ধ অবস্থায় ইনি বহুতীর্থ পরিভ্রমণ করেন। এই থেকে তাঁর নাম হয় অণীমাণ্ডব্য। উল্লেখ্য অণী অর্থ-শূলের অগ্রভাগ।

    মুনি অত্যন্ত গ্লানি নিয়ে, একদিন যমরাজের কাছে তাঁর এই শাস্তির কারণ জানতে চাওয়ায়− যমরাজ বলেন যে, 'বাল্যকালে আপনি একটি পতঙ্গের (ফড়িং) মলদ্বারে দূর্বাতৃণ প্রবেশ করিয়েছিলেন- সেই পাপের ফল আপনাকে ভোগ করতে হচ্ছে।'  মুনি এতে রাগান্বিত হয়ে বললেন. 'লঘু পাপে আপনি আমাকে গুরু দণ্ড দিয়েছেন। এই কারণে, আপনাকে শাস্তি স্বরূপ শূদ্রযোনিতে জন্মগ্রহণ করতে হবে।' 

এই অভিশাপের কারণে, পরবর্তী কালে যমরাজ, বিচিত্রবীর্যের প্রথমা স্ত্রী অম্বিকার শূদ্র দাসীর গর্ভে এবং ব্যাসদেবের ঔরসে "বিদুর"-- রূপে জন্মেছিলেন।

 মুনি এরপর একটি আইন প্রবর্তন করেন। আইনটি হলো ---  চৌদ্দ বৎসরের পূর্বে অজ্ঞানকৃত পাপের জন্য কেউ দণ্ডভোগ করবে না এবং পঞ্চদশ বর্ষ অবধি কর্ম্মানুসারে ফললাভ হবে ।।

( ক্রমশ)

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments