মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৩০
কার্তিক গিরি (ডাঙের পুতুল শিল্পী, ভাজাচাউলি)
ভাস্করব্রত পতি
তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন মেদিনীপুরের এক অত্যাশ্চর্য লোকসংস্কৃতিকে। তিনি টিকিয়ে রেখেছেন গ্রামবাংলার এক জনপ্রিয় লোকআঙ্গিককে। তিনি ধরে রেখেছেন লুপ্তপ্রায় লৌকিক ঘরানাকে। তিনি কার্তিক গিরি। তিনি একজন প্রখ্যাত, প্রতিষ্ঠিত, প্রধান ও প্রথম সারির পুতুলনাচের শিল্পী। অগ্রগামী পুতুল থিয়েটারের মূল স্থপতি।
১৯৫৩ সালের ৬ ই মে মারিশদা থানার ভাজাচাউলি গ্রাম পঞ্চায়েতের খানকাখুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই পুতুলশিল্পী কার্তিক গিরি। সুরেন্দ্রনাথ এবং প্রফুল্লবালার দুই মেয়ে এবং তিন ছেলের মধ্যে তিনি মধ্যম সন্তান।
একসময় টিকিট সেলের যাত্রাদলে ৪ - ৫ বছর অভিনয় করেছেন। সেইসাথে গানও করেছেন। কিন্তু এভাবে রঙ মেখে যাত্রা করতে তাঁর ভালো লাগতো না। তিনি চেয়েছিলেন মূক মুখে ভাষা জোগাতে। তাই তিনি যাত্রাশিল্পী হিসেবে নয়, জীবিত চরিত্র হয়ে নয়, তিনি বেছে নিয়েছিলেন প্রাণহীন চরিত্রের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করে দর্শকদের আনন্দ দিতে। আসলে যাত্রাদলে থাকাকালীন যুক্ত হয়ে পড়েন নিজের বাড়ির সামনে বাঘা মহাকালি গ্রামের সুধাসিন্ধু পড়্যার পুতুল নাচের দলে। জড়ভরত পুতুলগুলো যেভাবে মানুষের ছোঁয়ায় রক্তমাংসের চরিত্র হয়ে ওঠে, সেই টেকনিক শিখতে চেষ্টা করেন। এখানে যুক্ত ছিলেন আরও ৪ - ৫ বছর। ধীরে ধীরে আয়ত্ব করে নেন মৃত পুতুলদের মুখে বাকশক্তি এবং অভিনয়শক্তি আরোপ করার যাবতীয় পদ্ধতি।
এবার ভাবলেন, নিজেই দল গড়বেন। তাঁর অঙ্গুলি হেলনেই কথা বলবে রাজা উজির পাত্র মিত্রদের পুতুল। মঞ্চ দাপাবে তাঁরা। সত্যিকারের মানুষের মতো হাঁসবে, কাঁদবে, হাঁটবে, ছুটবে, দৌড়াবে, লাফাবে, যুদ্ধ করবে, ভালোবাসবে। যা দেখে সামনে বসে থাকা দর্শককূলও পাগলপারা হয়ে উঠবে। তাঁদের মনে তখন একটাই প্রশ্ন জাগবে -- পুতুলগুলোও অভিনয় করতে পারে মানুষের মতো!
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ১৯৭৮ সালে খুলে ফেললেন সম্পূর্ণ নিজের পুতুল থিয়েটারের দল। নাম দিলেন অগ্রগামী পুতুল থিয়েটার। ১৯৮৮ পর্যন্ত প্রথম দশ বছর ধরে তাঁর ছিল তারের পুতুল নাচানোর কসরত। কিন্তু বাজারে টিকে থাকতে, অভিনবত্ব আনতে এবং বৈচিত্র্য আনতে তারের পুতুলের সাথে ডাঙের পুতুল যুক্ত করলেন। অর্থাৎ স্টিং পাপেট এবং রড পাপেটকে একসাথে মিশিয়ে গড়ে তুললেন দর্শক মনোরঞ্জনের নতুন এক ধারা। সফলও হলেন চূড়ান্তভাবে।
নতুন ধারার পুতুল নাটকে মেতে উঠলেন দর্শকরা। খুশিতে আত্মহারা তাঁরা। বিশ্বাসযোগ্য অভিনয়, মঞ্চ উপস্থাপন, আলোকের কারিকুরি, অসাধারণ চিত্রনাট্য আর সুন্দর নাটকীয় পরিবেশকে সম্বল করে চারিদিকে জয়জয়কার। দারুন প্রশংসা পেলেন সর্বত্র। বাহবা কুড়োতে শুরু করলেন প্রতিটি আসর থেকেই। ফলে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলো কার্তিক গিরির পুতুল থিয়েটারের। আর বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁর পুতুল নাচের দলের অনুষ্ঠানের বুকিং আসতে লাগলো।
১৯৯৮ থেকে তাঁর প্রাণপ্রিয় অগ্রগামী পুতুল থিয়েটার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বীকৃতি পেয়েছে। সরকারের তথ্য সংস্কৃতি বিভাগের বদান্যতায় নানা ধরনের সরকারি প্রকল্প রূপায়িত করতে পেরেছে তাঁর থিয়েটার দল। সেইসাথে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা দপ্তর, ভারত সরকারের বেতার মন্ত্রণালয়ের তথ্য, সংগীত ও নাটক বিভাগ, ভারত সরকারের পূর্বাচল সাংস্কৃতিক বিভাগ, নিউ দিল্লীর বিজ্ঞান প্রসার বিভাগ, নিউ দিল্লীর সংগীত ও নাটক আকাদেমী ইত্যাদি বেশকিছু সরকারী বিভাগগুলিতে কার্তিক গিরির অগ্রগামী পুতুল থিয়েটারের নাম নথিভুক্ত। এইসব সংস্থার আমন্ত্রণ এবং আহ্বানে তিনি অগ্রগামী পুতুল থিয়েটারের শিল্পীদের নিয়ে যান পুতুল থিয়েটারের অভিনয় প্রদর্শন করতে।
কার্তিক গিরি লিখেছেন অসংখ্য পালাগান। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটক রচনা করেছেন পুতুল নাটকের জন্য। প্রতিটি নাটক দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাঁর লেখা জনপ্রিয় নাটকগুলি হল -- আলিফ লায়লা, রূপবান কন্যা, বাবা আসামী ছেলে পুলিশ, নাগমাতা মনসা, বিশ্বগ্রাসী গ্রহরাজ শনি, আলিবাবা চল্লিশ চোর, আদ্যাশক্তি মহামায়া, কুরুক্ষেত্রের সারথি, হনুমানের লঙ্কাকান্ড, শ্মশানে কাঁদছে হরিশচন্দ্র, পনের আগুনে জ্বলছে নারী, প্রগতির পথে নারী প্রভৃতি। এসব নাটক রাতের পর রাত মাতিয়েছে গ্রামগঞ্জ। শুধু মেদিনীপুর নয়, নাটকের এই সম্ভার নিয়ে মেদিনীপুরের এই মানুষটি ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিদেশ বিভুঁই। কুড়িয়ে নিয়েছেন অপরিমেয় শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর সমীহ আদায়কারী শিল্পীর তকমা।
কেবলমাত্র পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নাটক লিখে পুতুল নাটকে জনপ্রিয়তা পাননি। সমাজের অবক্ষয় সহ অন্ধকার দিক দূর করতে এবং সমাজ সচেতনতার পাঠ দিতেও তিনি লিখেছেন অসংখ্য নাটক। সেইসাথে তিনি সরকারের নানা প্রকল্প তথা সাক্ষরতা ও সচেতনতা নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু নাটক। যেমন -- ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া, দেবো না টিপ সহি, পালস পোলিও, কুষ্ঠ, মাতৃমঙ্গল, জাগো গ্রাহক জাগো, এইডসের জীবন মরণ ইত্যাদি। এইসব বিষয়ের মাধ্যমে মানব সমাজকে সচেতন করতে তিনি তাঁর পুতুলদের ব্যবহার করেছেন। মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র ছিটিয়ে বাকহারা পুতুলদের সবাক করেছেন। জিতে নিয়েছেন সকলের হৃদয়।
সারিবদ্ধ পুতুলের সাথে ডাং পুতুলের অন্যতম শিল্পী কার্তিক গিরি
তিনি পুতুল নাচের আসর জমিয়েছেন কাঁথি, পাঁশকুড়া, কোলাঘাট, তমলুক, আসানসোল, লালগড়, বহরমপুর, পুরুলিয়া, মেচাদা, শালবনি, কল্যাণী, রাঁচি, হলদিয়া, ঝাড়গ্রাম, গড়বেতা, মেদিনীপুর টাউন থেকে কলকাতার রবীন্দ্র সরোবর, যাদবপুর পুলিশ ষ্টেশনের সূর্যসেন ভবন, রাজস্থানের জয়পুর, জওহর কলাকেন্দ্র, উড়িষ্যার কেঁওনঝড়, বারিপাদা, বালেশ্বর, চাঁদিপুর, নিউ দিল্লীর রবীন্দ্র ভবন এলাকায়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেও নিয়ে গিয়েছেন তাঁর দলকে। সব জায়গায় পেয়েছেন অকুণ্ঠ প্রশংসা এবং তারিফযোগ্য পিঠচাপড়ানি। আজও তাঁর সেই গরিমা বজায় রেখেছেন।
রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে পেয়েছেন অসংখ্য শংসাপত্র এবং সম্বর্ধনা। তাঁর পুতুল নাটকের সিডি সংখ্যা ২৭ এর বেশি। বিভিন্ন জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে তিনি পুতুল নাচকে তুলে ধরেছেন তাঁর নিজস্ব ক্যারিশ্মায়। কার্তিক গিরির লেখা নাটক 'বাবা আসামী ছেলে পুলিশ' এর চিত্রনাট্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
পুতুল অন্তপ্রাণ এই মানুষটি মেদিনীপুরের এই লোকঘরানাটিকে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী টিকিয়ে রেখেছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা এই মুহূর্তে উঠে না এলে হয়তো তাঁর অবর্তমানে হারিয়ে যাবে পুতুল থিয়েটারের যাবতীয় কারিকুরি। মঞ্চের পেছনে নেপথ্যে থেকে হাত মুখের কায়দায় স্টেজের সামনে থাকা জড় পুতুলগুলিতে প্রাণসঞ্চার করেন তিনি।
🍂
1 Comments
কার্তিক বাবুর মতো নিরলস লোকশিল্পীরা আছেন বলেই এক অনন্য শিল্পধারা আজও বহমান রয়েছে। নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা যে সবটা কেড়ে নিতে পারেনি তা কার্তিক বাবুদের কথা পড়ে বুঝতে পারি। অগ্রগামী পুতুল থিয়েটারের সকলের জন্য রইলো আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
ReplyDelete